চীনকে ঠেকাতে মিত্রদের এক কাতারে আনতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?

পিউ ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ ভাগ মানুষ চীনকে হুমকি মনে করছে, যেখানে রাশিয়ার প্রতি এমন মনোভাব রাখেন মাত্র ১৭ শতাংশ।
চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র
জো বাইডেন ও শি জিনপিং। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত শতাব্দীর সত্তর দশকের গোড়ার দিকের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন।

তবে ৫ দশক পরে এসে সেই সম্পর্ক হয়ে পড়েছে একেবারেই শীতল। পিউ ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ চীনকে হুমকি মনে করছেন, যেখানে রাশিয়ার প্রতি এমন মনোভাব রাখেন মাত্র ১৭ শতাংশ।

মূলত অর্থনীতি ও নিরাপত্তার কারণেই চীনকে হুমকি মনে করছেন অধিকাংশ মার্কিনি।

তবে চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই সতর্কতা নতুন নয়। ২০১৮ সাল থেকে দেশ ২টির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। বাইডেন ২০২০ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও বেইজিংয়ের দ্বন্দ্ব ছিল। শি জিনপিং চীনের ক্ষমতায় আছেন ১ দশক হলো। এরইমধ্যে তাইওয়ান, হংকং, ব্রিকস ও ইউক্রেন যুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে তাদের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে।

তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে বেইজিং। হংকংয়ে তারা জারি করেছে নিজস্ব নিরাপত্তা আইন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র হংকংয়ে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা (জিএসপি) বাতিল করেছে। সংখ্যালঘু উইঘুর ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এ বিষয়গুলোকে সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছে চীন।

ট্রাম্পের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পে চীনকে 'পৃথিবীব্যাপী প্রভুত্ব কায়েম করতে চাওয়া স্বৈরাচার' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

এদিকে জি-৭ এর বিপরীতে ব্রিকস গঠন করে নিজেদের অর্থনৈতিক প্রভাব বজার রাখতে চাচ্ছে চীন। ব্রিকসে আছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এই সংগঠনটির সদস্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে চীন। এ নিয়ে কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এর মাত্রা আরও বেড়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্ত আছে। তাদের সমর্থন ইউক্রেনের দিকে। বিপরীতে চীন প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়াকে।

একসময় পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে 'হাসির পাত্র' হলেও সম্প্রতি জি-৭ এর জিডিপিকে অতিক্রম করেছে ব্রিকস। অ্যাক্রন ম্যাক্রো কনসাল্টিংয়ের তথ্য অনুসারে, ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর বর্তমান জিডিপির সম্মিলিত পরিমাণ ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ও জি-৭ এর ক্ষেত্রে তা ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ।

ব্রাজিলের সাও পাওলোর গেটুলিও ভারগোস ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক অলিভার স্টুকেঙ্কেলের মতে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই পশ্চিমের দেশগুলোর থেকে বিশ্ব ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে এশিয়ায়; আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে—চীনের হাতে।

চীনের সঙ্গে ভারত ও রাশিয়ার মতানৈক্য থাকলেও ব্রিকসের বিষয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিনিয়োগে পশ্চিমের আধিপত্য কমে চীনের আধিপত্য বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে ব্রিকস। ইউরোপের অর্থনীতি জ্বালানি সংকটে টালমাটাল। তাই সুবিধাজনক অবস্থায় চীন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তথা আইএমএফ। এর বিপরীতে চীনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এনডিবি তথা নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক। এর মাধ্যমে চীন ৩০ শতাংশ ঋণ ডলারে না দিয়ে স্থানীয় মুদ্রায় দিচ্ছে, ফলে ডলারের আধিপত্য কমছে।

অনেকেই মনে করেন চীনের সরকার অগণতান্ত্রিক ও প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী। ব্রিটেনের সংসদীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে চীনকে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্ভাব্য পরাশক্তি হিসেবে দেখছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অশনি সংকেত।

সম্প্রতি আফগানিস্তানে প্রায় ২ দশক ধরে চলা যুদ্ধের পর সেনা প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও তারা প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়টা চীনের জন্যও ছিল চ্যালেঞ্জের। ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়ানানমেন স্কয়ারে হয়েছিল তুমুল আন্দোলন। সোভিয়েতের পতন ও স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিশ্বের 'মুকুটহীন সম্রাট' হয় যুক্তরাষ্ট্র।

তবে গত ২ দশকে কয়েকটি যুদ্ধে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট অর্থ ব্যয় হয়েছে। পশ্চিমের শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলা একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছিল ঐক্যবদ্ধ। সে সময় সবারই সাধারণ শত্রু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

কিন্তু চীনের অবস্থান সেখান থেকে অনেক দূরে। এশিয়ার বহু দেশ অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীনের ওপরই নির্ভরশীল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও চীনের রয়েছে বড় আকারের বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব। কাজেই চীনকে ঠেকাতে হলে, পশ্চিমের দেশগুলোকে যেভাবে একজোট হতে হবে, তা খুব একটা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

প্রবৃদ্ধির হিসাবেও যুক্তরাষ্ট্রের ২/৩ শতাংশের বিপরীতে চীন এগোচ্ছে ৫/৬ শতাংশ হারে। চীনকে রুখতে গেলে অ্যাপল, ওয়ালমার্ট, ক্যারিফোরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি হারাবে। কাজেই সাধারণ শত্রু হিসেবে চীনকে দেখা ও এর বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্য প্রায় অসম্ভব।

বেইজিংয়ে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কেরি ব্রাউন মনে করেন, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় লন্ডন এখন ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দিক থেকে বেইজিংয়ের তুলনায় পিছিয়ে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিনিয়োগ, তা চীনের তুলনায় দুর্বল। নিজেদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে পশ্চিমের দেশগুলোকে ইস্পাতকঠিন ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন কেরি।

যুক্তরাষ্ট্র গত ১৫ বছরে দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সৈন্য পাঠিয়েছে, বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে, যুদ্ধে জড়িয়েছে। চীনের চিত্র ভিন্ন৷ বাইরের পৃথিবী থেকে সেখানকার মানুষ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। দেশের ভেতর, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের ভেতরও আছে সংঘাত। তা সত্ত্বেও চীন বিশ্ব রাজনীতি ও বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আত্মতুষ্টি নয়, বরং আত্মসমালোচনা করে নিজেদের বুঝতে হবে পশ্চিমাদের, এমনটিই মনে করছেন কেরি ব্রাউন।

বর্তমানে পৃথিবীর সামষ্টিক অর্থনীতির অন্তত ২০ ভাগ আছে চীনের। রাশিয়ার মাত্র ২ ভাগ। তাই রাশিয়াকে স্বাভাবিকভাবেই অত বড় হুমকি মনে করে না পাশ্চাত্য। তবে চীন যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে এই শতাব্দীর মধ্যে তারা হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর মূল পরাশক্তি। এর বিপরীতে পশ্চিমের দেশগুলো কতটুকু ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তা এখন দেখার বিষয়।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সিএনবিসি ও বিবিসি

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

1h ago