মনা মামার হালিম নিয়ে কেন সবাই কথা বলছে

মনা মামার হালিম
ছবি: জান্নাতুল বুশরা

কিছুদিন হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলেছে মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের একটি হালিম। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন আমি কোন হালিমের কথা বলছি। এক বাটি ঘন, সুগন্ধিযুক্ত, তিন টুকরো গরুর মাংস দেওয়া সোনালি রঙের হালিম; যার ওপর ছড়ানো থাকে সেদ্ধ কোয়েল পাখির ডিম!

সবার এই হালিমের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, আসলেই এটি জনপ্রিয় হওয়ার মতো কিনা তা চেখে দেখব। তাই ঠিকানা ধরে ছুটে গেলাম সলিমুল্লাহ রোডে। এই সড়কটি বিভিন্ন ধরনের কাবাবের দোকানের জন্য এরই মধ্যে বিখ্যাত হয়ে গেছে। সেখানে বাতাসে ভেসে বেড়ায় দারুণ মশলার সুগন্ধ। আর এই সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছেন মনা মামা। ইনিই সেই মানুষ যিনি উৎসাহী ও রসনাবিলাসী মানুষের হাতে তুলে দেন গরম গরম হালিমের বাটি। বিখ্যাত এই হালিমের জন্য অপেক্ষা করাও ছিল দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ।

সলিমুল্লাহ রোডে কাঙিক্ষত জায়গাটিতে পৌঁছে আমি বুঝতে পারলাম, মনা মামার হালিমের জন্য উন্মাদনা নতুন কোনো বিষয় নয়। তিনি এখানে গত ৩০ বছর ধরে হালিম বিক্রি করছেন। তার দোকানের নাম মনা মামা হালিম অ্যান্ড স্যুপ। যার স্বত্বাধিকারী হলেন আব্দুল মান্নান, যিনিই মূলত আমাদের মনা মামা।

তো যাই হোক, আমি মুখে একটি মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে তার কাছে গেলাম। প্রত্যাশা ছিল, হালিমের ওপর কোয়েলের ডিম ছড়িয়ে পরিবেশনের পেছনের গল্প শুনতে পারব। কিন্তু আমার কৌতূহলে পানি ঢেলে দিয়ে তিনি বললেন, 'এখন না মামা, পরে।'

আমি কিছুটা বিব্রতই হলাম। তবুও ভিড় কমে যাওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। এই ফাঁকে হালিম খেতে আসা ক্রেতা আর রসনাবিলাসীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামতও জানতে চেষ্টা করলাম।

হালিম
ছবি: জান্নাতুল বুশরা

ধোঁয়াওঠা হালিমের বাটির ছবি তুলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নাবিলা।

তিনি বললেন, 'সোশ্যাল মিডিয়া আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এক চামচ খাওয়ার পরেই বুঝেছি যে এখানে আমি আবার আসব। হাইপ উঠুক আর না উঠুক, আমি আসব। এটার স্বাদ দারুণ।'

প্রথম চামচ মুখে দেওয়ার পর আমিও বুঝতে পেরেছিলাম যে নাবিলা মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। এক কামড়ে মাংস আর ডিমের সংমিশ্রণ, হালিমের স্বাদকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। খাবারটি বেশ ঘন, দারুণ সুস্বাদু, মশলার একেবারে যথাযথ মিশ্রণ যাকে বলে। আর এর সঙ্গে কোয়েলের ডিম যুক্ত হয়ে খাবারটিকে করে তুলেছে অনন্য। বিশেষ করে শীতের সন্ধ্যায় এই এক বাটি গরম হালিমকে কমফোর্ট ফুড বলা যেতেই পারে।

কোয়েলের ডিমই মনা মামার হালিমকে অন্য সব হালিম থেকে আলাদা করে বলে মনে করেন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সঞ্চয়।

তিনি বলেন, 'এই ডিমই মনা মামার হালিমকে ভালো থেকে অবিস্মরণীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়।'

ভেবে দেখলাম, সঞ্চয় যথাযথ উদাহরণই দিয়েছেন। তবে আমার জন্য কেবল ডিম নয়, মাংসের যথাযথ ভারসাম্যও মনা মামার হালিমকে অনন্য করেছে। বাটির মধ্যে থাকা তিন টুকরো সুসিদ্ধ মাংসই বরং আমার কাছে গেম চেঞ্জার।

মনা মামার দোকানটি খুব বড় নয়, রাস্তার ধারে অবস্থিত ছোট একটি রেস্তোরাঁ যেখানে সাকুল্যে ২৫ জনের বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখানে বিখ্যাত হালিম ছাড়াও পাওয়া যায় চিকেন স্যুপ আর অনথন। এই খাবারগুলোর জন্যও বহু মানুষ দোকানটিতে ফিরে আসেন।

হালিম
ছবি: জান্নাতুল বুশরা

এই দোকানে খাবার বিক্রির কিছু নিয়ম আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি ভেতরে বসার জায়গা না পাচ্ছেন ততক্ষণ আপনাকে খাবার পরিবেশন করা হবে না। সুতরাং আপনার ভাগ্য খারাপ হলে কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। সেই সময় তুলনামূলক ভাগ্যবানদের দোকানে বসে মজার হালিম বা স্যুপ উপভোগ করতে দেখতে হবে সেইসঙ্গে তাদের যেন দ্রুত খাওয়া হয়ে যায় সেই প্রার্থনাও মনে মনে করতে থাকবেন। আগেই বলে রাখি, এই অপেক্ষা বেশ হতাশাজনক।

বাইরে দাঁড়ানো এক গ্রাহক বেশ চিৎকার করেই বললেন, 'বড় দোকান কেন নেন না মামা? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়?'

মনা মানা সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলেন, 'ভাড়ার টাকা দেন মামা, দোকান বাড়াইতেসি।'

মামার উত্তর শুনে হাসতে গিয়ে রীতিমতো গলায় খাবার আটকে যাচ্ছিল আমার। আরেকটু হলেই মুখ থেকে হালিম সব ছিটকে বের হয়ে যাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলার মতো সময় মনা মামার হলো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, কোয়েলের ডিম দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে নাটকীয় কোনো উত্তর পাবো তার কাছ থেকে। হয়তো দারুণ কোনো ঘটনা আবিস্কার করে ফেলব। কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি বললেন, 'এটা কোনো ব্যাপার হলো? একদিন সকালে উঠে মনে হলো, আমার হালিমের সঙ্গে কোয়েলের ডিম পরিবেশন করব।'

ব্যস! এটুকুই। কোনো বিরাট ভাষণ নয়, না কোনো রহস্যের জট ছাড়াল। তার মাথার মধ্যে হুট করে আসা একটি ধারণা থেকেই এই হালিমের পথচলা।

গল্প শুনে হতাশ লাগছে? মনা মামার দোকান ঘুরে আসুন। কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাইপ উঠেছে সেজন্য নয়, সুস্বাদু হালিমের স্বাদ নিতে সেখানে যান। বিশ্বাস করুন, হতাশ হবে না।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

In Sarishabari, para sandesh sweetens Eid celebrations

Behind each piece of this delicate dessert lies hard work and precision

1h ago