ভিটামিন ‘কে’ কেন প্রয়োজন, মিলবে কোন খাবারে, শিশুদের জন্য কেন জরুরি

একটি অতি প্রয়োজনীয় কিন্তু অনেক সময় অবহেলিত ভিটামিন হলো ভিটামিন কে। রক্ত জমাট বাঁধা থেকে শুরু করে হাড়ের গঠন এবং হৃদ্রোগের ঝুঁকি হ্রাসে এই ভিটামিনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর নাম খুব বেশি আলোচনায় না আসায় অনেকেই এর প্রয়োজনীয়তা, উৎস ও ঘাটতির লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন নন।
চলুন জেনে নেই ভিটামিন কে এর উৎস কী, কেন প্রয়োজন, এটির অভাবে কী হতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আঞ্জুমান আরা শিমুল।
আঞ্জুমান আরা শিমুল জানান, ভিটামিন কে হলো একটি চর্বি-দ্রবণীয় ভিটামিন যা সবুজ শাকসবজিতে পাওয়া যায় এবং এটি অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারাও উৎপাদিত হয়। রক্ত জমাট বাঁধা, সুস্থ হাড় এবং অন্যান্য টিস্যুর জন্য এটি অপরিহার্য। এর অভাব রক্তপাতের ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে নবজাতকদের ক্ষেত্রে, এবং সহজে ক্ষত এবং দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাতও হতে পারে।
ভিটামিন কে কী
ভিটামিন কে একটি ফ্যাট-সলিউবল (চর্বিতে দ্রবণীয়) ভিটামিন, যা মূলত দুই ধরনের হয়।
১. ভিটামিন কে১: এটি প্রাকৃতিকভাবে সবুজ শাকসবজিতে পাওয়া যায়।
২. ভিটামিন কে২: এটি কিছু কিছু প্রাণিজ খাদ্য ও অন্ত্রে বসবাসকারী ভালো ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত হয়।
কেন ভিটামিন কে প্রয়োজন?
ভিটামিন কে শরীরের বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রক্ত জমাট বাঁধা
আমাদের শরীরে কোনো কাটা বা আঘাতের পর রক্তপাত থামাতে যে প্রোটিনগুলো কাজ করে, সেগুলোর সক্রিয়তায় ভিটামিন কে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
হাড়ের স্বাস্থ্য
এটি অস্টিওক্যালসিন নামক একটি প্রোটিনকে সক্রিয় করে, যা হাড়ে ক্যালসিয়াম জমাতে সাহায্য করে। ফলে হাড় থাকে শক্তিশালী ও টেকসই।
হৃদ্রোগ প্রতিরোধ
গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন কে ধমনীতে ক্যালসিয়াম জমা রোধ করে, যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়।
অন্যান্য কাজ
গবেষণায় দেখা গেছে যে ভিটামিন কে-এর অন্যান্য উপকারী প্রভাব থাকতে পারে, যেমন কোলন, পাকস্থলী, প্রোস্টেট, মুখ এবং নাকের ক্যানসার প্রতিরোধ করা এবং লিভার ক্যানসার রোগীদের স্থিতিশীল করা।
ভিটামিন 'কে'র অভাবে কী হতে পারে
- যদিও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভিটামিন কের ঘাটতি তুলনামূলক কম দেখা যায়, তবে যাদের দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ইতিহাস আছে, পিত্ত বা অন্ত্রের রোগ রয়েছে বা যারা অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করেন, তাদের ক্ষেত্রে ঘাটতির ঝুঁকি বাড়ে।
- সহজেই রক্তপাত হওয়া (কাটা বা ঘা শুকাতে সময় লাগা)
- নাক ও মুখ থেকে রক্ত পড়া
- দাঁত ব্রাশের সময় মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
- অতিরিক্ত ঋতুস্রাব
- হাড় দুর্বল হওয়া বা সহজে ভেঙে যাওয়া (অস্টিওপোরোসিস)
- নবজাতকের ক্ষেত্রে ইনট্রাক্রেনিয়াল ব্লিডিং বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ
- কিছু ক্ষেত্রে, ভিটামিন কের অভাব হাড়ের ব্যথা, পেশী দুর্বলতা এবং ক্লান্তিও সৃষ্টি করতে পারে।
- শিশু ফর্মুলা ভিটামিন কে দিয়ে সমৃদ্ধ। কিন্তু বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুদেরও কয়েক সপ্তাহ ধরে ভিটামিন কে কম থাকতে পারে, যতক্ষণ না তাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া বিকশিত হয়। এটি নবজাতকের রক্তক্ষরণজনিত রোগের কারণ হতে পারে।
ভিটামিন 'কে'র খাদ্য উৎস কী
ভিটামিন কে১-এর প্রধান উৎস হলো সবুজ শাকসবজি। অন্যদিকে ভিটামিন কে২ পাওয়া যায় নির্দিষ্ট কিছু খাবার ও অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে।
ভিটামিন কে১ এর উৎস: পালং শাক, কচু শাক, বাঁধাকপি, ব্রকলি, লেটুস, সরিষা শাক, ধনেপাতা, হেলেঞ্চা কলমি, শালগম শাক ইত্যাদি। ব্রোকলি, ব্রাসেলস স্প্রাউট এবং ফুলকপির মতো অন্যান্য সবজিতেও ভিটামিন কে থাকে।
ভিটামিন কে২ এর উৎস: ডিমের কুসুম, লিভার (যকৃত), ঘরে তৈরি দই ন্যাটো (জাপানি ফার্মেন্টেড সোয়াবিন খাবার) কিছু ফার্মেন্টেড চিজ।
শিশু খাদ্য: শিশু খাদ্য বা ইনফ্যান্ট ফর্মুলা ফরটিফাই করার জন্য ভিটামিন কে দিয়ে শক্তিশালী করা হয়।
বাংলাদেশের সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে শাকসবজি এবং দুধজাত পণ্যের উপস্থিতি থাকলেও ভিটামিন কে২ এর পরিমাণ তুলনামূলক কম হতে পারে, বিশেষ করে যদি কেউ শাকপাতা বা প্রাণিজ পণ্য কম খান।
অন্যান্য উৎস
অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া: অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ভিটামিন কে এর একটি রূপ ভিটামিন কে২ সংশ্লেষিত করতে পারে।
ভিটামিন কে ইনজেকশন: নবজাতকদের প্রায়শই রক্তপাতের ব্যাধি প্রতিরোধের জন্য ভিটামিন কে ইনজেকশন দেওয়া হয়।
শিশুদের জন্য ভিটামিন কে কেন জরুরি
নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে ভিটামিন কের ঘাটতি মারাত্মক হতে পারে। জন্মের পরপরই শিশুদের শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন কে না থাকায় 'নিউবর্ন হেমোরেজ ডিজঅর্ডার' দেখা দিতে পারে, যা প্রাণঘাতী হতে পারে। এজন্যই অনেক দেশে জন্মের পরপরই শিশুদের ইনজেকশন বা মুখে ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়।
কীভাবে পর্যাপ্ত ভিটামিন কে নিশ্চিত করা যায়
- দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় সবুজ শাকসবজি রাখা উচিত।
- প্রতিদিন অন্তত এক কাপ ভাপে সিদ্ধ বা হালকা রান্না করা শাক খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
- যাদের হজমজনিত সমস্যা আছে, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন।
- শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মের পর হাসপাতাল থেকে দেওয়া ভিটামিন কে ইনজেকশন গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ভিটামিন কের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, সচেতন খাদ্যাভ্যাস ও শিশুদের সময়মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করলেই ভিটামিন কে জনিত সমস্যাগুলো সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
Comments