মোহ নাকি প্রেম, বোঝা কি সম্ভব?

ছবি: সংগৃহীত

`কেউ প্রেম করে, কেউ প্রেমে পড়ে– আমার হয়েছে কোনটা?'

কারো সঙ্গে ঘুরছেন, ফিরছেন, ভীষণ ভালো লাগছে। একে অন্যের মধ্যকার এই রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপার যত সামনে এগোচ্ছে, ততই নিজের সঙ্গে এই গানটি মিলিয়ে ফেলছেন। আনমনে হাসছেন, চেনা গলিতেই হয়তো পথ ভুলে যাচ্ছেন। কাল হো না হো সিনেমার গানের মতো প্রতিদিন নিয়ম করে নিজেকেই বলে চলেছেন, 'কুছ তো হুয়া হ্যায়, কুছ হো গায়া হ্যায়!'

এমন সময়ে নিজেকে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি বোকা বোকা লাগে, আবার এই অনুভূতি এতটাই ভালো লাগে যে বেশি বুদ্ধিমান হতেও ইচ্ছে করে না। কে না জানে, একমাত্র হৃদয়ঘটিত বিষয়েই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা বেঁধেছে? অন্তত সাহিত্য বা সিনেমার জগতে তাই দেখা যায়। নয়তো কি আর দেবদাসের মতো অত নাক উঁচু লোকটার এই পরিণতি হয়?

কিন্তু নিছক মোহ নাকি প্রেম, ভালোলাগার একটা পর্যায়ে গিয়ে এমন প্রশ্ন অনেকেরই মাথায় আসে। ফারাক বুঝবেন কীভাবে? সে নিয়েই আজকের এই লেখা। নচিকেতা যতই গলা ফাটিয়ে বলুন, 'ইট'স আ গেইম', তবু ভালোবাসা কিংবা প্রেমের ফর্মুলা সবার ক্ষেত্রে একেবারেই এক নয়।

মোহ আর প্রেমের মাঝে কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্য হিসেব কষে বের করা যায়, যা কোথাও না কোথাও মোহ আর প্রেমকে আলাদা করতে পারে। মোহ শব্দটিকে সাধারণত ভ্রান্তির সঙ্গে মেলানো হয়। একজন ব্যক্তি যখন অপরজন সম্পর্কে নিজেরই মনে একটা 'ইমেজ' তৈরি করে নেন এবং সেই ইমেজটিকেই সত্য বলে ধরে নিয়ে, অথবা মঞ্চনাটকের মূলমন্ত্র 'সাসপেনশন অব ডিসবিলিফে' নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন, তখন সেটি প্রেমের চাইতে বেশি 'মোহ' হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির প্রকৃত সত্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটলে মোহ ভেঙে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ঘটনা।

অন্যদিকে প্রেমের ক্ষেত্রে দরকার হয় শুধু নিখুঁত, নির্ভুল একটি চরিত্রকে উচ্চ আসনে বসিয়ে রাখা নয়, সমানে সমানে চলতে পারা, ঠিক-ভুলে গড়া মানুষটাকে আপন করে নিতে পারার প্রবণতা অথবা ইচ্ছে। এই ইচ্ছেটুকু মোহের ক্ষেত্রে না আসার সম্ভাবনাই বেশি। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি এক্ষেত্রে প্রচেষ্টাও করতে চাইবেন না, কারণ তার কাছে তৈরিকৃত সত্যটাই প্রকৃত সত্যের চেয়ে বেশি উপভোগ্য।

মোহ থেকে প্রেম

মোহের একটি মেয়াদ রয়েছে। কারো কারো ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ মোহ কখনো যেমন রূপ নিতে পারে ঔদাসীন্য কিংবা নিছক মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায়, এই মুদ্রার অন্য পিঠে আবার রয়েছে আশার সোনালি সিন্ধু। একটা সময়ের পর মোহের বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত হয়ে প্রেমেও রূপ নিতে পারে। তবে তার জন্য সব আবশ্যক নিয়ামকের যোগান মেলাটা খুব জরুরি। নয়তো মোহের বেলুন চুপসে যাওয়া থেকে ঠেকানো মুশকিল। অবশ্য ঠেকানোর দরকারও কি আছে আদৌ?

অতঃপর আইনস্টাইন, অতঃপর 'আপেক্ষিকতা'

মাঝে মাঝেই মনে হয়, পদার্থবিজ্ঞানে আইনস্টাইন যদি আপেক্ষিকতার সূত্র নিয়ে অত ঘাঁটাঘাঁটি না করতেন, তবে বোধহয় মানবজীবনের খুব সহজ কিছু বিষয় প্রকাশ করাটা আরো জটিল হয়ে যেত। আর কিছু না হোক, অন্তত 'আপেক্ষিকতা' শব্দটা তো আমাদের। তাই মোহ, প্রেম বা মনের অলিগলির অন্য অন্য মারপ্যাঁচে ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর কিছুই নেই। কারো কাছে হুমায়ূন আহমেদের সেই উক্তির মতোই মনে হতে পারে, 'ভালোবাসাবাসির জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই– একটি মুহূর্তই যথেষ্ট', আবার কেউবা দীর্ঘমেয়াদে না পেলে প্রেম বলে স্বীকার করতেই পিছপা হবেন।

হয়তো সে দলের বিশ্বাস রূপ নেয় শঙ্খ ঘোষের কবিতায়, 'হাতের পর হাত রাখা সহজ নয়, সারা জীবন বইতে পারা– সহজ নয়।' ওদিকে অন্যপক্ষ আবার প্রেমকে কেন সারা জীবনের গণ্ডিতে বাঁধতেই হবে, এমন একটা ভ্রূকুটি বাঁকানো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে সদাপ্রস্তুত। তাই বুকের ওই ধুকপুকানি সন্ধ্যেগুলো– পথের পানে চেয়ে থাকা, কিংবা একটা ফোনকলের জন্য অধীর আগ্রহের অপেক্ষা আদৌ মোহ নাকি প্রেম, তা না হয় যার যার মনের মানচিত্রেই লেখা থাক।

কারণ মানব 'মন' বা 'হৃদয়' যে নামেই ডাকা হোক না কেন, জীবনের এই একটা ছকে এসে বহু রথী-মহারথীই কোনো একটি পথকে 'ঠিক' বলে নিতে পারেন না। হোঁচট খান নিজেরই অনুভূতির সঙ্গে। তবে একটা জীবন বৈ তো কিছু নেই আমাদের হাতে! খুব করে নাটক-সিনেমার মতো সূত্র মিলিয়ে ভালোবাসাবাসি না পাক, একে অপরকে নির্ভরতা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে পারাটাই কম কি!

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

5h ago