শিশুদের বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা থেকে দূরে রাখতে যা করবেন

 চলুন দেখে নিই ঘরের ভেতরে ও বাইরে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা থেকে শিশুর জীবন বাঁচাতে কী কী উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।
বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা
ছবি: ফ্রিপিক

১১ হাজার ভোল্টের ট্রান্সমিশন কেবলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাত থেকে কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ৭ বছর বয়সী এক শিশুর। ঘটনাটি কুমিল্লার সংরাইশ নামক একটি এলাকার, ঘটেছে গত ১ ফেব্রুয়ারি। শিশুটি বর্তমানে চিকিৎসাধীন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

শুধু প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোই নয়, দেশের আধুনিক শহরগুলোও মুক্ত নয় এমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে। বিশেষ করে আবাসিক এলাকাগুলো যেখানে উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ দিয়ে পরিবেষ্টিত, সেখানে শিশুর খেলার জায়গাটি নিমেষেই পরিণত হতে পারে মরণফাঁদে। এমনকি ঘরের ভেতরটাও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। তাই শিশুর নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ব্যবস্থা গ্রহণের।

 চলুন দেখে নিই ঘরের ভেতরে ও বাইরে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা থেকে শিশুর জীবন বাঁচাতে কী কী উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।

 

 

 

ঘরের ভেতর প্রয়োজনীয় সাবধানতা:

দেয়ালের বৈদ্যুতিক সকেটগুলো আবৃত রাখা

ঘরের দেয়ালের নিচের দিকে প্রায় সময় দেখা যায় বিদ্যুৎ সংযোগের উৎসগুলো অনাবৃত থাকে। এ ছাড়া ব্যবহার শেষে প্লাগ খুলে ফেলার পর সেগুলো অনাবৃত অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়। এগুলো বাচ্চাদের হাতের নাগালেই থাকে। খেলার ছলে এগুলোর ছোট গর্তগুলোতে বাচ্চাদের হাত চলে যেতে পারে। এমন ঘটনা থেকে বাঁচতে বৈদ্যুতিক আউটলেট কভার বা সেফটি প্লাগের আবির্ভাব।

প্লাগগুলো মূলত টু পিং ও থ্রি পিং সকেটের জন্য সামঞ্জস্য করে তৈরি করা হয়। আর কভারের ক্ষেত্রে বর্তমানের অত্যাধুনিক স্লাইডিং আবরণীগুলো ব্যবহার শেষে কোনো অ্যাডাপ্টারের প্লাগ খুলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সকেটটিকে ঢেকে ফেলে। এতে করে বিদ্যুৎ সংযোগের গর্তগুলো আবৃত হয়ে যায় এবং তাতে বাচ্চাদের হাত পড়লেও কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকে না।

বিদ্যুতের কেবল গুছিয়ে রাখা

শুধু নিরাপত্তার জন্য নয়, ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে কেবল অর্গানাইজার। এলোমেলো করে ছড়ানো-ছিটানো কেবল বা তারগুলোতে বাচ্চাদের ছোট ছোট হাত-পা জড়িয়ে যেতে পারে। ছুটে বেড়াতে গিয়ে এগুলোতে পা জড়িয়ে পড়ে যেয়ে আঘাত পেতে পারে তারা। আর কোনো একটিতে ছোট কোনো চিড় বা লিকেজ থাকলে তা মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তাই নিদেনপক্ষে দড়ি বা ফিতা দিয়ে কেবল বা তারগুলোকে বেঁধে পরিপাটি করে রাখা উচিত।

তাছাড়া এখন অধিকাংশ ইলেকট্রনিক পণ্যের সঙ্গে এগুলোর কেবল গুছিয়ে রাখার জন্য ছোট ছোট প্লাস্টিকের তার সরবরাহ করা হয়। এগুলোর যথাযথ ব্যবহার করে তার বা কেবলগুলো আড়াল করে রাখা উচিত।

ওভারলোড না করা

একটি আউটলেটে একাধিক ডিভাইস ব্যবহারের উপায় থাকলেও তার সুবিধা নেওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে উচ্চ পাওয়ার রেটিংয়ের বৈদ্যুতিক আসবাব একটি আউটলেটে একটির বেশি ব্যবহার করা ঠিক নয়। এতে আউটলেটগুলো অতিরিক্ত গরম হয়ে সকেটের পেছনে তার বা আসবাবের কেবল পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া শর্ট সার্কিট হলে একসঙ্গে একাধিক যন্ত্র নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।

বিদ্যুতের প্রতিটি সংযোগের ত্রুটিহীনতা নিশ্চিত করা

ঘরের প্রতিটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ করছে কি না তা রুটিন মাফিক যাচাই করা হলে সময়মতো ত্রুটিগুলো চোখে পড়বে। এতে করে যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় থাকবে। সেইসঙ্গে নিশ্চিত হবে প্রত্যেকটির নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার। আর ঘরের ভেতরে শিশুর খেলার জায়গাটিও হবে ঝুঁকিমুক্ত।

বৈদ্যুতিক যন্ত্র কোনোভাবেই পানির সংস্পর্শে না আনা

রান্নাঘর ও টয়লেটের বৈদ্যুতিক আউটলেটগুলোকে কোনোভাবেই ভেজা রাখা যাবে না। প্রয়োজনে নিয়মিত শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে রাখতে হবে। দিনের অধিকাংশ সময়ই এই স্থানগুলোতে পানির কাজ থাকে। ফলে যে কোনো ভুলে মেঝেতে পানি পড়ে তা গড়িয়ে চলে আসতে পারে ডাইনিং বা অন্যান্য ঘরগুলোতে। পরিণতিতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে শিশুর খেলে বেড়ানোর জায়গাটি।

ফ্রিজ বা ওভেনের মতো উচ্চ ভোল্টেজের যন্ত্রপাতির পেছনের স্থান কোনোভাবেই যেন পানির সান্নিধ্যে না আসে। এগুলোর কেবলে হঠাৎ পানি লেগে গেলে দ্রুত পাওয়ার অফ করে শুকনো কাপড় দিয়ে তা মুছে নিতে হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিদ্যুতের ডিভাইস বন্ধ করে রাখা

সাধারণত ঝড় ও বজ্রপাতের সময় তার বা কেবলে চিড় ধরতে পারে কিংবা বিদ্যুতের ডিভাইসগুলো দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহ হতে পারে। এমন সময় শিশুরা কোনো বিদ্যুতায়িত আসবাবের সান্নিধ্যে থাকলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অবশ্য বিল্ডিংগুলোতে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের ওভারলোডিংয়ের পরিণতি থেকে দূরে থাকা যায়। এরপরেও দুর্যোগকালীন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির পাওয়ার অফ করে রাখাটাই উত্তম।

সতর্কতাগুলো বাচ্চাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া

বাচ্চাদের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে বেশি দরকার বিদ্যুতের সঙ্গে সম্পর্কিত সতর্কতার বিষয়গুলো তাদেরকে বুঝিয়ে বলা। ঘর ও ঘরের আসবাবপত্রের কোন কোন স্থানগুলো কখন স্পর্শ করা যাবে না এবং কোথায় কোথায় যাওয়া ঠিক নয়, তা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে।

সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে অভিভাবকরা বৈদ্যুতিক সেফটির নিয়মগুলো মেনে চলে শিশুর সামনে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা। অনুকরণপ্রিয় শিশুরা তখন তাদের দেখে শেখা শুরু করবে। এভাবে প্রতিদিন এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হলে তা পরিণত হবে অভ্যাসে।

ঘরের বাইরে প্রয়োজনীয় সাবধানতা:

বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত পোল বা গাছ থেকে শিশুদের দূরে রাখা

মাথার ওপরের পাওয়ার লাইনগুলো একের পর এক খুঁটির মাধ্যমে স্থাপিত হয়ে শহর ও গ্রামে দূর-দূরান্তে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এগুলোর মাঝে কখনও গাছ পড়ে যায় অথবা গাছের অবলম্বন নিয়েও খুঁটি স্থাপন করা হয়। বাচ্চাদের নিয়ে রাস্তায় চলাচলের সময় এই গাছ বা খুঁটিগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। এমনকি শহরের অলিতেগলিতে খেলাধুলা করার সময়ে বাচ্চারা যেন এই খুঁটি বা গাছগুলোতে চড়ে না বসে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।

ছেঁড়া কেবলের কাছে শিশুদের আসতে না দেওয়া

ঝড়-বৃষ্টির পরে, দালান নির্মাণসহ নানা নির্মাণ কাজে প্রায় সময় দেখা যায় রাস্তায় জমে থাকা পানিতে পাওয়ার লাইন ছিঁড়ে পড়ে আছে। শুধু পানির সঙ্গে সংযোগকৃত অবস্থাতেই নয়, শিশুদের কোনো অবস্থাতেই রাস্তায় ঝুলে থাকা ছেঁড়া কেবল বা তারের সংস্পর্শে আসতে দেওয়া যাবে না। কোথাও এমন অবস্থা দেখলে শিগগিরই বিদ্যুৎ বিভাগের হটলাইন নাম্বার ১৬৯৯৯-এ কল করে জানাতে হবে।

খোলা জায়গায় শিশুদের খেলার ব্যবস্থা করা

ঘুড়ি উড়ানোর সময় ওভারহেড পাওয়ার কেবল বা তার সংস্পর্শে থাকা গাছে আটকে যাওয়ায় প্রায়ই শিশুরা তা ছুটিয়ে নিতে গাছে চড়ে বসে। এ সময় শুধু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়াই নয়, ওপর থেকে পড়ে যাওয়ারও ভয় থাকে। এ ছাড়া বর্তমানে ড্রোন নিয়ে খেলা করা শিশুরাও এই বিড়ম্বনার শিকার হয়।

এ অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় বিদ্যুতের লোকদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া উপযুক্ত  ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এক্ষেত্রে সচেতন এলাকার প্রাপ্তবয়স্করা এগিয়ে আসবেন। এর বিকল্প হিসেবে শিশুদের খোলা মাঠ বা পার্কে খেলার ব্যবস্থা করতে হবে। মেঘলা দিনে বজ্রপাতের আশঙ্কা থাকায় ঘুড়ি বা ড্রোন না ওড়ানোই ভালো।

বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের আশপাশে বাচ্চাদের যেতে না দেওয়া

যে অঞ্চলগুলোতে আবাসিক এলাকার কাছাকাছি পাওয়ার সাবস্টেশন আছে সেখানকার অভিভাবকদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। যে বাচ্চারা অভিভাবক ছাড়া স্কুলে যাওয়া-আসা করে বা বিকেলে খেলতে বের হয়, তারা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে এ ধরনের এলাকায়। তারা খেলার ছলে বা কোনো পোষা প্রাণীর পেছনে ছুটতে গিয়ে সাবস্টেশনের বেষ্টনীর কাছাকাছি চলে যেতে পারে। এ অবস্থায় সাবস্টেশনের আশেপাশে বাচ্চাদের আনাগোনার দিকে এলাকার অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

ঝড়-বৃষ্টির দিনে শিশুদের সাঁতার কাটা থেকে দূরে রাখা

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সুইমিং পুল বা পুকুরে সাঁতার কাটাও শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ সময় আশপাশের খুঁটি ভেঙে বা মাথার ওপরের পাওয়ার লাইন ছিঁড়ে পড়ে পুরো জলাশয়কে বিদ্যুতায়িত করে ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক মুষলধারে বৃষ্টির সময় ভেজা শরীর নিয়ে কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের আশেপাশের বাচ্চাদের যেতে দেওয়া যাবে না।

সর্বোপরি বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের জীবন বাঁচাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এরকম যাবতীয় উৎস থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে।

Comments