সাংবাদিকতা পড়েও কেন এই পেশায় আসছে না তরুণরা

সাংবাদিকতা একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা, যেখানে সত্য বলার সাহস প্রয়োজন সবার আগে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেও পেশাগত জীবনে সাংবাদিকতা বেছে নিচ্ছেন না। মৌখিক পরীক্ষায় যখন প্রশ্ন করা হয়—'কী হতে চাও?', প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই একই উত্তর, সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করলেও, এ পেশায় যাওয়ার ইচ্ছে কারো নেই। এমনকি বিভাগগুলোয় শিক্ষক হিসেবে যারা যোগদান করেন, তাদের অধিকাংশই যোগাযোগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী হলেও সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা আছে, এমন শিক্ষকের সংখ্যা কম।
এক সময় তরুণদের মধ্যে এই পেশা বেছে নেওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কেউ কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষেই মনে করে, এই পেশা তাদের জন্য নয়। এমনকি যারা পড়াশোনা শেষ করেও কিছুদিন চেষ্টা করেন, তারাও হতাশ হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতে, বর্তমানে শিক্ষার্থী ভর্তি হারও কমে গেছে। পূর্বে যেখানে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতা হতো, এখন অনেক শিক্ষার্থী ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও শুধু ইউনিটভিত্তিক সুযোগের কারণে এই বিভাগে ভর্তি হচ্ছেন। ফলে শুরু থেকেই তারা এই বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে, যারা আগ্রহ নিয়ে আসেন, তারাও একসময় বাস্তব পরিস্থিতি দেখে মনোবল হারিয়ে ফেলেন। সাংবাদিকতা এখন আর শুধু কলমের জোরে চলা পেশা নয়, বরং টেকনোলজিক্যাল স্কিল, ভিডিও প্রেজেন্টেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্টের মতো নানা দিক জানা জরুরি। কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো এই আধুনিক বিষয়গুলো শেখার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই।
কেন আগ্রহ হারাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
প্রথমত, বেতন ও পেশাগত নিরাপত্তার অভাব বড় অন্তরায়। বাংলাদেশে অধিকাংশ গণমাধ্যমে প্রবেশ পর্যায়ে সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন কাঠামো থাকে না। কাজের পরিমাণ ও চাপ পূর্ণকালীন হলেও, তার স্বীকৃতি বা পারিশ্রমিক খুবই সীমিত। ফলে অনেকেই আর্থিক দিক বিবেচনা করে সাংবাদিকতা থেকে সরে গিয়ে অন্য পেশায় চলে যান।
অন্যতম কারণ হলো, সিলেবাসের সঙ্গে বাস্তবতার পার্থক্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সাংবাদিকতা শেখানো হয়, তা অনেক সময়ই আধুনিক গণমাধ্যমের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে মেলে না। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ঘাটতি, ডেটাভিত্তিক রিপোর্টিং, ডিজিটাল স্কিলস বা মোবাইল জার্নালিজম শেখার সুযোগ খুব সীমিত। ফলে পাস করে বের হওয়ার পর চাকরি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েন। এটা শুধু সাংবাদিকতা ভিত্তিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেই নয়, বরং অন্যান্য কোর্সে এমনটা হয়ে থাকে।
উত্তরণের উপায়
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন কাঠামোগত একটি পরিকল্পিত পরিবর্তন। বেতন কাঠামো নির্ধারণ, চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাংবাদিকদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাজনৈতিক চাপ বা হুমকি মোকাবিলায় আইনি সহায়তা ও পেশাদার সমর্থন গড়ে তোলার পাশাপাশি নারী সাংবাদিকদের জন্য হয়রানিমুক্ত, সহনশীল ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ ও ফেলোশিপ চালুর পাশাপাশি ডিজিটাল সাংবাদিকতা, ডেটা রিপোর্টিং, ফ্যাক্ট-চেকিং—এমন নতুন প্রযুক্তিনির্ভর বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যক্রম হালনাগাদ করতে হবে, যেন তা বাস্তবধর্মী হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদমাধ্যমের মধ্যে সমন্বয় করতে মিডিয়া হাউসগুলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ, মেন্টরশিপ, ফিল্ড অ্যাসাইনমেন্টে যুক্ত করতে পারে। পাশাপাশি একাডেমিক জার্নালিজম ও প্র্যাকটিক্যাল রিপোর্টিংয়ের মধ্যে ব্যবধান কমাতে দুই পক্ষের নিয়মিত যোগাযোগ ও কাজ করা যেতে পারে।
Comments