মিটিংয়ে কম কথা বলেও যেভাবে নিজের গুরুত্ব বোঝাতে পারেন

মিটিংয়ে কথা বলা
ছবি: সংগৃহীত

আমরা যারা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত, তারা মাঝে মাঝেই সহকর্মী হিসেবে কিছু মানুষকে পাই যাদের মূল কাজ মিটিংয়ে কথা বলা। যে বিষয়টাকে আড়ালে-আবডালে আমরা বলি 'ফটফট করা'। খেয়াল করে দেখবেন, এই ধরনের সহকর্মীরা কাজের টেবিলে যতটুকু না পটু, কিংবা নিজের কাজ যতটুকু না করেন, তার চেয়ে কথা বলেন। বিশেষ করে মিটিং হলে তো আর কথাই নেই। বড় কর্তাদের সামনে তাদের কথোপকথন শুনলে মনে হয়, অফিসের সব কাজ তারাই করেন। বাকিরা অফিসে শুধূ আসা-যাওয়া করেন আর কি!

এক অফিসে আমার একজন সহকর্মী ছিলেন। যিনি ডেস্কের চেয়ে নিচে চায়ের দোকানে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু সাপ্তাহিক বা মাসিক মিটিংয়ে তার পরিকল্পনা, অফিসের সমস্যা, তার কাজের ফিরিস্তি শুনলে মনে হতো, আমরা বাকিরা আসলে তেমন কোনও কাজ না করেই বেতন নিয়ে যাচ্ছি। কারণ সব কাজ তো আদতে তিনিই করেন।

কিন্তু যখন বছর শেষে মূল্যায়ন হলো, দেখা গেল ওই সহকর্মীর বেতন তার প্রত্যাশার চেয়ে তো বটেই বাকিদের ভাবনার চেয়েও কম হলো। অর্থাৎ, মিটিংগুলোয় তার 'গলাবাজি' কোনো কাজেই আসেনি। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে কর্মদক্ষতা, নিয়মানুবর্তিতা, সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মক্ষেত্রের জন্য সহায়ক কর্মকাণ্ড।

অনেক কর্মীই মনে করেন, কর্মক্ষেত্রে সবার নজরে আসতে হলে মিটিংয়ে কথা বলতে হয়। ধারণাটি আসলে অর্ধসত্য। কাজের প্রয়োজনে সবার সঙ্গে আলোচনা করা জরুরি, কিন্তু কেবল মিটিংয়ে বেশি কথা বলে, নিজেকে জাহির করে কিংবা নিজের গুরুত্ব তুলে ধরে ক্যারিয়ারে উন্নতি করা সম্ভব নয়। বরং এর চেয়ে জরুরি আপনি কখন, কীভাবে, কোন কথা বলছেন, সে বিষয়টি।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সাধারণত মিটিংগুলোয় প্রচুর কথা হয়। কর্মীদের মধ্যে যাদের ব্যক্তিত্ব তুলনামূলক দৃঢ়, তারাই এসব মিটিংয়ের নেতৃত্ব দেন। সমস্যা হলো, সবাই মিলে যখন কথা বলেন তখন বরং এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলে কেউ কারো কথা ঠিকমতো শোনেন না বা এত কথা হয় যে সব কথা পরে মনেও থাকে না। তাই মিটিংয়ে কথা বলাই ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটা কেউ ভেবে থাকলে তা আদতে ভুল।

কর্মীরা প্রায়ই এই ভুল করে থাকেন যে, তারা মনে করেন মিটিংয়ে অংশ নিয়ে কথা বলা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি আপনার কাজ কথা না বলে তাহলে মিটিংয়ে হাজার হাজার কথা বলেও দিনশেষে লাভ হবে না। প্রয়োজন অনুযায়ী কথা বলতে হবে, সঠিক সময়ে বলতে হবে এবং অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের উন্নতিরে জন্য দৃশ্যমান কাজ করতে হবে।

মিটিংয়ে প্রচুর কথা বলার আগে এটা মনে রাখতে হবে যে, সেখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই জ্যেষ্ঠ বা অভিজ্ঞ কর্মীরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন এবং তাদের কথাই তুলনামূলক বেশি মন দিয়ে শোনা হবে। তাই নিজের অবস্থান বুঝে সময়মতো কেবল প্রয়োজনীয় কথাটুকুই বলা উচিত।

কীভাবে নিজেকে শোনাবেন

এখন প্রশ্ন হলো, কোন উপায়ে নিজের কথা অন্যকে শোনাবেন। বেশি কথা বলার চেয়ে জরুরি হলো এমন ব্যবস্থা করা যেন সবাই আগ্রহ ভরেই আপনার কথা শোনে। সে কারণে মিটিংয়ে যাওয়ার আগে পরিকল্পনা ঠিক করে নিতে হবে। যে বিষয়ে কথা বলতে চান সে সম্পর্কে ভালোভাবে জেনেবুঝে যেতে হবে। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হতে হবে এবং সে সম্পর্কে নিজের জানাশোনা বাড়িয়ে নিতে হবে। যেন মিটিংয়ে সে সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে ভাবতে না হয়।

এক্ষেত্রে সময়জ্ঞানও জরুরি। খুব বেশি সময় নিয়ে কথা বলা যাবে না। নিজের বক্তব্যের বা পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করতে হবে। আর সেটি করতে হবে এমনভাবে যেন মিটিংয়ে উপস্থিত অন্যরাই আগ্রহী হয়ে আপনার কাছে বিস্তারিত জানতে চান। সে কারণেই নিজের বক্তব্যে কী বলবেন বা কী পরিকল্পনা সাজাবেন তার পুরোটা নিজের মাথায় সাজিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

পরিকল্পনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সার্বজনীন কিছু না বলে সুনির্দিষ্ট করে বলুন। অর্থাৎ, আমরা ওমুক কাজটা করলে ভালো করব বা ওমুক পদক্ষেপ প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো হবে; এমন করে না বলে বলুন যে ওই কাজটি করলে প্রতিষ্ঠানের কী কী লাভ হবে। কিংবা আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে প্রতিষ্ঠানের লাভের পরিমাণ কেমন হতে পারে বা ঠিক কতটুকু উন্নতির সুযোগ রয়েছে তা জানান।

মিটিংই সব নয়

ফোর্বস বলছে, মিটিং হলো আপনার দৃশ্যমান পেশাজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু। কিন্তু মিটিংই সব নয়। আপনি কর্মক্ষেত্রে কেমন কাজ করছেন তার ওপর নির্ভর করবে যে মিটিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্বরটি আপনার হবে কিনা। আপনি যদি মিটিংয়ে গুরুত্ব পেতে চান, তাহলে কর্মক্ষেত্রে নিজের বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান তৈরি করুন। শক্ত অবস্থান তৈরি হলে মিটিংয়ে আর জোর করে কথা বলতে হবে না, সবাই এমনিতেই আপনার কথা শুনতে আগ্রহী হবে।

নীরবতাও কখনও কখনও শক্তিশালী

সব মিটিংয়েই যে আপনাকে কথা বলতে হবে বা সবাইকে সবসময় আপনার কথাই শুনতে হবে; বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। অনেক কর্মীই মনে করেন, মিটিংয়ে চুপ করে থাকলে বুঝি দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাবেন। কিন্তু এটা সবসময় মনে রাখতে হবে যে, কোনো প্রয়োজন ছাড়া কথা বললে উল্টো ক্যারিয়ারে ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে চুপ করে থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আপনার নীরবতা কথার চাইতেও শক্তিশালী হতে পারে।

এসময় চুপ থেকে অন্যের কথা শুনুন। কে কী ভাবছে বোঝার চেষ্টা করুন। যদি প্রয়োজন মনে হয় তখনই কেবল কথা বলুন।

দলের জন্য তৈরি হোন

কেবল নিজের কথা বললেই হবে না, আপনি দলগতভাবে বা দলে যুক্ত হয়ে কাজ করতে পারছেন কি না কর্মক্ষেত্রের জন্য সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিটিংয়ে যাওয়ার আগে নিজের দলের বা বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিন। নিজেই সবার পক্ষ থেকে সবসময় কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকবেন না। আপনি বরং থাকুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রভাগে। দেখবেন ঠিকই মিটিংয়ে সহকর্মীরা আপনাকে কথা বলতে বলবেন।

মিটিংয়ে কেবল কথা বলাই নিজেকে দৃশ্যপটে আনার একমাত্র উপায় নয়। কর্মক্ষেত্রগুলো কাজের মানুষ পছন্দ করে। আর যারা আপনার ওপরে থাকেন বা যারা কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদে থাকেন তারা বেশিরভাগ সময়ই হন অনেক অভিজ্ঞ। যারা সহজেই বুঝতে পারেন, কোন কর্মী গলাবাজী করছেন আর কে সত্যিই কাজ করছেন। তাই কাজের কোনো বিকল্প নেই। নিজের কাজ দিয়েই পরিচিত হোন, কাজ দিয়েই সহকর্মীদের প্রিয় হয়ে উঠুন।

 

Comments