যাদুকাটা নদী ভ্রমণে পাবেন মনে রাখার মতো স্মৃতি

 সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী
সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী। ছবি: ইউএনবি

প্রবাহমান স্বচ্ছ পানি, নীল দিগন্ত আর সবুজ গালিচার পাহাড়, সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব মিথস্ক্রিয়া সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী। সারাজীবন মনে রাখার মতো কোনো ভ্রমণের স্মৃতি জমিয়ে রাখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন নদীটি। 

অধিক বৃষ্টিপাতের সুফলটা এখানে দারুণভাবে উপভোগ করা যায় বর্ষা মৌসুমে। হাওড় ও নদী ভরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়গুলোও যেন সেজে ওঠে সাদা ঝর্ণায়। তেমনি এক অপরূপ জায়গা সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীতে ভ্রমণ নিয়েই আজকের নিবন্ধ।

যাদুকাটা নদীর ভৌগোলিক অবস্থান ও নামকরণের ইতিহাস

নদীটির উৎপত্তি ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়। বাংলাদেশের অংশে এর অবস্থান সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে। ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৫৭ মিটার প্রস্থের সর্পিলাকার নদীটি রক্তি নামে মিলেছে সুরমা নদীর সঙ্গে। সবুজ বনে ঢাকা বারেক টিলা আর খাসিয়ার মাঝে পড়েছে ৮ মিটার গভীর এই নদী, যার অববাহিকার আয়তন ১২৫ বর্গ কিলোমিটার। বিশ্বম্ভরপুর থেকে দক্ষিণে জামালগঞ্জ উপজেলা শহরে প্রবেশ করায় সেখানে গড়ে উঠেছে আনোয়ারপুর ও দুর্লভপুর নদীবন্দর দুটি।

যাদুকাটা নদীর প্রাচীন নাম রেনুকা। অনেক আগে এই নদীতীরেই গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী। এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে যাদুকাটা নদী।

লোকমুখে এক গল্প প্রচলিত আছে এই নদীটিকে নিয়ে। একবার এক গাঁয়ের বধু তার শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে মাছ কাটছিলেন। হঠাৎ এক পর্যায়ে অন্যমনষ্ক হয়ে ভুলবশত মাছের জায়গায় তার কোলের শিশুটিকেই কেটে ফেলেন। সেই শিশুপুত্রটির নাম ছিলো যাদু, আর গ্রামটি ছিলো এই নদীর তীরে। আর মাছটি ছিলো এই নদীরই মাছ। এই গল্প থেকেই নদীটির সঙ্গে জুড়ে যায় যাদুকাটা নামটি।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পর্যটন এলাকা

এই নদীর প্রবহমান স্বচ্ছ পানি, নীল দিগন্ত আর সবুজ গালিচার পাহাড়; সব মিলিয়ে প্রকৃতির যেন এক অপূর্ব মিথস্ক্রিয়া। নদীর প্রতিটি পাড় যেন প্রকৃতির আপন মহিমায় স্বযত্নে সাজানো। নৌকা দিয়ে ঘোরার সময় যাদুকাটা নদীতে চোখে পড়বে স্থানীয় শ্রমিকদের ব্যস্ত জীবন। সেই সুবহে সাদেকের সময় শুরু হয় তাদের কাজ আর সেটা চলতে থাকে সন্ধ্যা অবধি। তাদের পেশা নদী থেকে কয়লা, বালি ও পাথর আহরণ করা।

এ অপরূপ সৌন্দর্য্যের সঙ্গে জনজীবনের এক চিরন্তন মেলবন্ধন। আর এই রূপেই মুগ্ধ হয়ে এই নদীমুখী হন শত শত দর্শনার্থী। এমনকি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশ-বিভুঁই থেকেও পর্যটকরা এসে ভিড় জমান যাদুকাটার যাদু দেখতে। এখানে আসা দর্শনার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বর্ষার ঢলের সময় মেঘালয় পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ১৮টি পাহাড়ি ছড়া থেকে বেরিয়ে আসে চোখ জুরানো ঝর্ণা। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে শ্রী শ্রী অদ্বৈতা মহাপ্রভুর আশ্রম ও পূর্ণতীর্থ স্থান এবং শাহ আরেফিন আউলিয়ার আস্তানা। পশ্চিম তীরে দেখা যাবে এখানকার সবচেয়ে সেরা দর্শনীয় বস্তু; সুনামগঞ্জের আইফেল টাওয়ার। প্রায় ১৫০ ফুট উচ্চতার এই টাওয়ারটি বারেক টিলা নামে সুপরিচিত। আর পাহাড়ি সবুজের সঙ্গে ছন্দ মেলাতে নদীর পাশের বৃহত্তর শিমুল বাগান তো আছেই।

ভারতের সারি সারি উঁচু-নিচু মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড় ও বারেক টিলার বুকে ঘন সবুজের সমারোহ পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে।  এখানে হলহলিয়া নামক গ্রামে গেলে পাওয়া যাবে ৮০০ বছর পুরানো প্রাচীন লাউড় রাজ্যের হাবেলি রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ।

মেঘালয় পাদদেশে থাকা গারো মানুষদের ভাঙা ভাঙা বাংলা কথা বেশ আনন্দ দেয় পর্যটকদের। কখনো ইঞ্জিনচালিত নৌকা, কখনো বা ডিঙ্গিতে ভেসে, কখনো বা তীর ঘেষে পায়ে হেঁটে যাদুকাটার মন্ত্রমুগ্ধতা বিমোহিত হয়ে উপভোগ করে পর্যটকরা।

যাদুকাটা নদীতে যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে যাদুকাটা নদী ঘুরতে যেতে হলে প্রথমে সুনামগঞ্জ পৌঁছতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গার বাস টার্মিনালগুলো থেকে প্রতিদিনি সুনামগঞ্জের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। এগুলোর মধ্যে নন-এসি বাসে জনপ্রতি ভাড়া লাগতে পারে প্রায় ৭০০ টাকা আর এসি-বাসে গেলে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকার মতো। সুনামগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগতে পারে প্রায় ৮ ঘণ্টা। 

সুনামগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে মোটরসাইকেল অথবা সিএনজিচালিত অটো রিকশাগুলো যাদুকাটা নদী পৌঁছে দেয়। মোটরসাইকেলের ভাড়া পড়তে পারে প্রায় ২৫০ টাকার মতো। সিএনজি অটোতে ৭ জন হলে পুরোটা রিজার্ভ নেওয়া যায়। এ ছাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা ভাড়ায় যাদুকাটা যায়। ফেরার সময়েও একই পথে আসা যায়।

তবে পর্যটকরা সাধারণত একসঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওড়, টেকেরঘাটের নীলাদ্রী লেক, শিমুল বাগান ও যাদুকাটা নদী দেখে সুনামগঞ্জ ফিরে আসেন। এতে অল্প সময়ের মধ্যে ভ্রমণের খরচটা বেশ ভালোমতোই পুষিয়ে নেওয়া যায়। তাই হাতে একটু বেশি সময় নিয়ে (কমপক্ষে ২ দিন) ঘুরে আসা যেতে পারে যাদুকাটা নদীসহ অন্যান্য দর্শনীয় জায়গাগুলো।

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

যাদুকাটা নদীর আশেপাশে তেমন একটা থাকার ব্যবস্থা নেই। খুব বেশি ভিড় হলেও এখানকার পর্যটন সেবা বলতে তেমন কোনো স্থাপনা গড়ে উঠেনি। বড়ছড়া বাজারে গেলে থাকার জন্য কয়েকটি গেস্ট হাউজ পাওয়া যাবে। এখানে একদিনের জন্য মাথাপিছু ২০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ পড়তে পারে। আর তাহিরপুর বাজারে আছে দুটি আবাসিক হোটেল। সব চেয়ে ভালো সুনামগঞ্জ শহরে এসে থাকা। শহরে বিভিন্ন মান ভেদে হোটেল ভাড়া ২০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত।

লেকের পাশে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা একটি চুনা পাথরের কারখানা আছে। এর গেস্ট হাউসটা খালি থাকলে রাত্রিযাপনের জন্য এখানে থাকা যেতে পারে। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া সাপেক্ষে অনেকে উপজেলা ডাকবাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে নেয়।

খাবারের জন্য লাউড়ের গড় বাজারে পাওয়া যাবে সাধারণ মানের দেশীয় খাবার। বারিক্কা টিলার নিচের হোটেলগুলোও দুপুরের খাবারের জন্য মোটামুটি। এ ছাড়া বড়ছড়া বাজার, টেকেরঘাট বাজার, তাহিরপুর বাজারে মোটামোটি মানের খাবার দিয়ে উদরপূর্তি করা যাবে। কিন্তু ভালো খাবারের জন্য চলে আসতে হবে সুনামগঞ্জ শহরে। এখানকার রেস্টুরেন্টগুলো খাবারের মানের দিক থেকে বেশ ভালো। নদী দেখতে যাওয়ার সময় প্রয়োজনে এখান থেকে সঙ্গে করে কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যায়।

যাদুকাটা ভ্রমণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ

  • ভ্রমণের সময় লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখা উচিত।
  • এখানে দলবল মিলে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো।
  • খাবারের উচ্ছিষ্ট ও প্যাকেট পানিতে ফেলে নদীর পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না।
  • নৌকাতে মাইক বা মোবাইলে গান বাজিয়ে শব্দ দূষণ পরিহার করা উচিত।
  • রাতে অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলো জ্বালানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • মাছ, বন্যপ্রাণী এবং পাখি ধরা যাবে না। এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যেখানে এদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে।
  • নৌকার গলুই বা ছইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • ভ্রমণের পূর্বেই সিলেটের আবহাওয়ার সম্বন্ধে ভালো করে জেনে যেতে হবে। নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রতিকূল আবহাওয়া থাকলে নৌকায় চড়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
  • ভ্রমণের সময় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বা হারিয়ে গেলে জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ যোগাযোগ করে সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
  • যাত্রা শুরুর সময় নিয়মিত ওষুধ, টয়লেট পেপার, কয়েকটি বড় বড় পলিথিন, ব্যাকআপ ব্যাটারিসহ টর্চ লাইট, পাওয়ার ব্যাংক, মগ, রেইনকোর্ট বা ছাতা, চাদর, খাবার পানি, গামছা বা রুমাল এবং সহজে শুকিয়ে যায় এমন কাপড়-চোপড় সঙ্গে নেওয়া ভালো।

সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীতে ভ্রমণ সারা জীবনের জন্য স্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকতে পারে। আর এই অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করতেই বছরের সারাটা সময়ই টাঙ্গুয়ার হাওড়, টেকেরঘাট ও বারেক টিলা ঘুরে আসার সময় পর্যটকরা যাদুকাটা নদী দেখে আসেন। এখানে সরকারি বা বেসরকারিভাবে ইকোট্যুরিজম স্থাপন করা হলে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে জায়গাটি। শুধু যে সরকারেরই রাজস্ব আয় হবে তা নয়, স্থানীয় তরুণ সম্প্রদায়ও খুঁজে পাবে কর্মসংস্থানের জায়গা।

Comments

The Daily Star  | English
ADP implementation failure in Bangladesh health sector

Dev budget expenditure: Health ministry puts up poor show again

This marks yet another year of weak budget execution since the health ministry was split into two divisions in 2017.

10h ago