কী দেখবেন রাঙ্গামাটিতে

ছবি: শাহ ওয়াজিহা

স্বচ্ছ জলের বুকে ভেসে পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে চলে যান রাঙ্গামাটির পথে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাঙ্গামাটি জেলা। লেক, বন-বনানী, ঝর্ণা আর সবুজ পাহাড়ে বেষ্টিত দেশের সর্ববৃহৎ এ জেলাটি  প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর অপূর্ব এক স্থান।

পর্যটকের পদচারণায় প্রায় সব ঋতুতেই মুখরিত থাকে রাঙ্গামাটি। ৩-৪ দিন হাতে নিয়ে আসলে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা সম্ভব।

চলুন জেনে নিই ঘুরে দেখার মতো রাঙ্গামাটির কিছু স্থানের নাম-

কাপ্তাই হ্রদ

পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদ রাঙ্গামাটির অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এই হ্রদের আয়তন ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। কৃত্রিম হ্রদ হলেও এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যেকোনো মানুষকে। হ্রদের চারপাশ জুড়ে ছোট-বড় পাহাড়, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, ঝরনা যেন কাপ্তাইয়ের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

সারা বছরই কাপ্তাই লেক ভ্রমণে আসতে পারেন। তবে বর্ষায় লেকের পাশের ঝরনাগুলো পরিপূর্ণতা পায়। তাই বর্ষাকাল কাপ্তাই হ্রদের বুকে ভেসে বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। মূলত কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরেই রাঙ্গামাটির পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে। তাই ইঞ্জিন নৌকায় করে কাপ্তাইয়ের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে পারবেন।

নির্বাণ নগর বৌদ্ধ মন্দির

কাপ্তাই হ্রদের অজস্র জলরাশির মাঝখানে নিবিষ্ট মনে দাঁড়িয়ে থাকা গৌতম বুদ্ধের মূর্তিটি নজর কাড়বে যেকোনো ভ্রমণপিপাসু মানুষের। কাপ্তাই হ্রদের একটি দ্বীপে এই বৌদ্ধ মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। মন্দিরের নামটি আরও বেশি সুন্দর, 'নির্বাণ নগর বন বিহার'। বৌদ্ধ মন্দিরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ২৯ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতায় একটি বিরাট বুদ্ধ মূর্তি স্থানটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কাপ্তাই হ্রদ থেকে শুভলং যাওয়ার পথে দেখা মিলবে চমৎকার এই মন্দিরের।

ছবি: শাহ ওয়াজিহা

শুভলং ঝরনা

'লাল মেঘে বৃষ্টি ঝরে আদিবাসী কোনো গ্রামে

তোমার কান্না, আমার কান্না ঝিরিপথ হয়ে নামে।'

বলা হয়, ঝরনা নাকি পাহাড়ের কান্না। ভরা বর্ষা মৌসুমে ৩০০ ফুট উঁচু থেকে আছড়ে পড়া শুভলং ঝরনার জলধারা দেখলে মনে হবে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে পাহাড়৷ শুভলং ঝরনার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আর অপূর্ব সুরের মূর্ছনা পর্যটকদের বিমোহিত করে। তবে ঝরনার পরিপূর্ণ রূপ দেখতে পাবেন কেবল বর্ষাকালেই।

শুভলং ঝরনা রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার মধ্যে পড়েছে। কালিট্যাং তুগ এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, যার উচ্চতা প্রায় ১ হাজার ৮৭০ ফুট। এই পর্বতশৃঙ্গ থেকে পুরো রাঙ্গামাটি শহর দেখা যায়। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে যেন কাপ্তাইয়ের জলে ভেসে থাকা এক টুকরো স্বর্গরাজ্য। সেইসঙ্গে ভারতের মিজোরাম রাজ্যটিও দৃষ্টিগোচর হয়। শুভলংয়ে স্থলপথে আসার কোনো সুযোগ নেই। কাপ্তাই হ্রদের ওপর দিয়ে এখানে আসতে হয়।

ধুপপানি ঝরনা

২ কিলোমিটার দূর থেকে সাদা পানির এই ঝরনার ঝিরঝির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। ধুপপানি ঝরনার বিশেষত্ব এই যে, এখানে যেতে হলে আপনাকে থাকতে হবে একদম শান্ত হয়ে। নির্জন ও কোলাহলহীন এ ঝরনায় জোরে কথা বলাও বারণ। তাহলেই নাকি জেগে যাবেন ধ্যানরত সাধু!

ছবি: মো. জাহিদ হাসান

এই ঝরনার পাদদেশে সাধুর আশ্রমে ধ্যানমগ্ন থাকেন একজন সাধু। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয়, 'ভান্তে'। মানুষের কোলাহলে যাতে সাধুর ধ্যান না ভাঙে, এ কারণেই শব্দের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন স্থানীয়রা।

রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ওড়াছড়ি নামক স্থানে অবস্থিত এ ঝরনা। সমতল থেকে এই ঝরনার উচ্চতা প্রায় ১৫০ ফুট। কয়েক বছর আগেও লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল ঝরনাটি। ২০০০ সালের দিকে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গভীর অরণ্যে ধুপপানি ঝরনার নিচে ধ্যান শুরু করলে আস্তে আস্তে নজরে পড়ে এটি।

ধুপপানি ঝরনায় পৌঁছাতে দুর্গম ও খাড়া পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হবে। যাওয়ার সময় ধুপপানি পাড়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়ি গ্রাম দেখে যেতে পারবেন। আড়াই ঘণ্টা হাঁটার পরেই শুনতে পাবেন ঝরনার ঝিরিঝিরি আওয়াজ। পৌঁছানোর পর ধুপপানি ঝরনার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে মনে হবে, হেঁটে আসার কষ্ট সার্থক।

ফুরোমন পাহাড়

রাঙ্গামাটি শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ফুরোমন পাহাড়। পাহাড়ের নামটি যেমন বাহারি, প্রাকৃতিক শোভায় এটি ততোটাই মনোরম। চাকমা ভাষায় ফুরোমন অর্থ ফুরফুরে মন। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালে মন ফুরফুরে হয়ে যায় বলে নাম রাখা হয়েছে ফুরোমন।

এটির উচ্চতা ১ হাজার ৫১৮ ফুট। ট্রেকিং করে পাহাড়ের চূড়ায় গেলে দেখতে পাওয়া যাবে প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ। তবে পাহাড়ি রাস্তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পাহাড়ি বাঁক, খাড়া পাহাড় আর খানাখন্দ পেরিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৬০০ ফুট উঁচুতে গেলে দেখতে পাবেন অন্য এক পৃথিবী। ফুরোমনের চূড়া থেকে কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ নীলাভ জল, সবুজে ঘেরা পাহাড় আর বিস্তৃত আকাশ দেখে মনে হবে চোখের সামনে নেমে এসেছে স্বর্গপুরী।

ঝুলন্ত সেতু

রাঙ্গামাটি শহরের শেষপ্রান্তে হ্রদের ওপর গড়ে উঠেছে ঝুলন্ত সেতু। সেতুটি ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ, ৮ ফুট প্রশস্ত। ১৯৮৬ সালে নির্মিত হয় এই ব্রিজটি এখন 'সিম্বল অব রাঙ্গামাটি' হয়ে উঠেছে। 

সেতুতে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে লেকের অবারিত জলরাশি ও উঁচু-নিচু পাহাড় ঘেরা আকাশছোঁয়া বনাঞ্চল। যেকোনো দর্শনার্থীর নজর কাড়তে সক্ষম অপূর্ব এই ঝুলন্ত সেতু।

রাজবন বিহার

পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় তীর্থস্থান রাঙ্গামাটির ঐতিহ্যবাহী রাজবন বিহার। চাকমা ভাষায় বিহার বা মন্দিরকে 'কিয়াং' বলা হয়ে থাকে। রাজবন বিহার বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বৌদ্ধবিহার হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৩৩ দশমিক ৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত বিহার এলাকায় ৪টি মন্দির, ভিক্ষুদের ভাবনা কেন্দ্র, বেইনঘর, তাবতিংশ স্বর্গ, বিশ্রামাগার ও হাসপাতাল রয়েছে।

ছবি: আরশি চাকমা

পলওয়েল পার্ক

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আধুনিক স্থাপনাশৈলীর অপূর্ব সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই পার্কটি রাঙ্গামাটির অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে নির্মিত পলওতেল পার্কটি পরিচালনা করে রাঙ্গামাটি জেলা পুলিশ।

পার্কটির অন্যতম আকর্ষণ 'লাভ পয়েন্ট', যা লাভ লক বা ভালবাসার তালাখ্যাত 'লাভ' চিহ্নের একটি বিশেষ চরকি। ভালোবাসার বন্ধনকে চিরস্থায়ী করতে অনেকেই সঙ্গে করে একটি তালা নিয়ে আসেন এখানে। লোহা ও রড দিয়ে তৈরি বিশাল চরকির ভেতরে মানুষ তার প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে বাহারি ডিজাইনের তালা ঝুলিয়ে চাবিটি হ্রদে ফেলে দেয়।

জুমঘর রেস্টুরেন্ট

ছবি: অহনা তাসনুভা

প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে পাহাড়ি খাবারের স্বাদ পেতে চলে যান জুমঘর রেস্টুরেন্টে। পর্যটকদের কাছে এখনো ততোটা জনপ্রিয়তা না পেলেও, কাপ্তাইয়ের প্রান্তে পাহাড়ের ওপর বানানো এই রেস্টুরেন্টটি বেশ শৌখিন। খাবারের মানও বেশ ভালো। খাওয়া শেষে মাত্র ২০ টাকা টিকিট মূল্যে ঘুরে দেখতে পারেন পাহাড়ের ওপর ছোট ছোট ঘর করে বানানো জাদুঘর।

 

Comments

The Daily Star  | English

Jewellers cut gold prices by Tk 3,452 a bhori

From tomorrow, each bhori of 22-carat gold will cost Tk 138,708

53m ago