ভ্রমণ

চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের ৭ প্রাসাদ

সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক এবং ঐতিহাসিক কারণে এই প্রাসাদগুলো এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের প্রাসাদগুলো ঐতিহাসিকভাবে রাজা ও রাজ পরিবারের আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে প্রাসাদ শুধু রাজ পরিবারের বাসস্থান নয়, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সম্মান ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির প্রতীকও। প্রাসাদগুলো তাদের অনন্য স্থাপত্যশৈলী এবং সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত। সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক এবং ঐতিহাসিক কারণে এই প্রাসাদগুলো এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

এই লেখায় আমরা বিশ্বের এমন ৭টি রাজপ্রাসাদের কথা উল্লেখ করব, যেগুলোর সৌন্দর্যের টানে সারা বছরই পর্যটকদের ভীড় লেগে থাকে।

প্যালেস অব ভার্সাই, ফ্রান্স

ছবি: সংগৃহীত

রাজা ত্রয়োদশ লুই যখন বয়সে তরুণ ছিলেন, তখন তার শিকারের লজ হিসেবেই এই প্রাসাদটির যাত্রা শুরু হয়। ১৬২৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে ১২ মাইল পশ্চিমে ভার্সাইতে এই রাজপ্রাসাদটির গোড়াপত্তন হয়। যদিও পরবর্তীতে রাজা চতুর্দশ লুই বেশ কয়েক ধাপে এর উল্লেখযোগ্য পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেন এবং ১৬৮২ সালে এটিকে তার নিজের রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন।

ফরাসি বিপ্লবের পর ২ হাজার একর আয়তনজুড়ে অবস্থিত বিশাল এই প্রাসাদটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের এই প্রাসাদটি দেখতে প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ভার্সাইতে যান।

তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘর, তুরস্ক

ছবি: সংগৃহীত

তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে অবস্থিত এই রাজপ্রাসাদে একসময় উসমানীয় (অটোমান) সুলতানরা বসবাস করতেন। বর্তমানে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। ১৪৫৯ সালে কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের পর সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ বসফরাস প্রণালীর তীরে এই প্রাসাদটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৯২৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এটিকে জাদুঘরে পরিণত করা হয় এবং বর্তমানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র।

প্রাসাদটিতে ৪টি কোর্টইয়ার্ড, একটি হারেম, বাগান, রাজকীয় গেট এবং শত শত কক্ষ আছে। তবে মাত্র গত বছর এর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো জনসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পর্যটকরা এখন চাইলে এই প্রাসাদের হারেমও দেখতে পারেন। প্রাসাদ জাদুঘরে তোপকাপি ড্যাগার, অসংখ্য ধর্মীয় ও উল্লেখযোগ্য নিদর্শন, অটোমান সাম্রাজ্যের পোশাকসহ বহু উপকরণ আছে।

আলহামরা, গ্রানাডা, স্পেন

ছবি: সংগৃহীত

এই প্রাসাদটি ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এবং ইসলামি বিশ্বের অন্যতম সংরক্ষিত প্রাসাদগুলোর মধ্যে একটি। এটি স্পেনের আন্দালুসিয়ার গ্রানাডা শহরে অবস্থিত। স্পেনের নাসরি রাজবংশের শাসনামলে এই প্রাাসাদটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১২৩৮ সালে প্রথম নাসরি আমির মুহাম্মদ ইবনে আল-আহমার এর নির্মাণ কাজ শুরু করলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে রাজা প্রথম ইউসুফ এবং পঞ্চম মুহাম্মদের শাসনামলে এই নির্মাণকাজ শেষ হয়।

আমেরিকা আবিষ্কারের জন্য ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানি ইসাবেলার উপস্থিতিতে এই প্রাসাদেই রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য রাজপ্রাসাদের তুলনায় আলহামরা অনেক দিক থেকেই অনন্য। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যকলা, অসাধারণ পরিকল্পনা ও ডিজাইন এবং দারুণ সাজসজ্জা প্রাসাদটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

শোনব্রুন প্রাসাদ, অস্ট্রিয়া

ছবি: সংগৃহীত

এটি ছিল হাবসবার্গ সাম্রাজ্যের শাসকদের প্রধান গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান। শোনব্রুন শব্দের অর্থ 'সুন্দর ঝরনা'। প্রাসাদের ভেতরের একটি কূপ থেকে এই নামের উৎপত্তি। ১৪৪১ কক্ষের এই বিশাল প্রাসাদটি ১৯৫০ এর দশক থেকেই ভিয়েনার অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র।

সপ্তদশ শতকে নির্মিত প্রাসাদটির ইতিহাস এবং এর বিশাল বাগানগুলো যেন হাবসবার্গ সম্রাটদের রুচি, আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। শোনব্রুন প্রাসাদটি সমগ্র ইউরোপজুড়ে সুপরিচিত, কারণ একটি স্মারক মুদ্রায় এই প্রসাদের ছবি ব্যবহার করা হয়ছে।

মহীশূর প্রাসাদ, ভারত

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের কর্নাটকে অবস্থিত মহীশূর প্রাসাদ বা মাইসোর প্যালেস অম্বা বিলাস প্রাসাদ নামেও পরিচিত। এক সময় এটি ছিল ওয়াদিয়ার রাজবংশের বাসভবন। মহীশূর প্রাসাদ বলতে বোঝানো হয় দুর্গের ভেতরের একটি প্রাসাদকে। চতুর্দশ শতাব্দীতে মহীশূরের প্রথম রাজা আদি ইয়াদুরায়া প্রাচীন দূর্গের ভেতরে প্রথম প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৬ সালে এক বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় প্রাসাদটি আগুনে পুড়ে যায় এবং একাধিকবার পুনঃনির্মাণ করা হয়।

ওই সময়ের রাজা ব্রিটিশ স্থপতি হেনরি আরভিনকে একটি নতুন প্রাসাদ নির্মাণের জন্য নিয়োগ দেন এবং ১৯১২ সালে প্রাসাদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ১৯৩০ সালে প্রাসাদটির নির্মাণপরিধি আরও বাড়ানো হয় এবং পাবলিক দরবার হল উইংটি নির্মাণ করা হয়। তাজমহলের পরে মহীশূর প্রাসাদ ভারতের দ্বিতীয় সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র।

রয়্যাল প্যালেস অব মাদ্রিদ, স্পেন

ছবি: সংগৃহীত

স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক প্রাসাদে ৩ হাজার ৪১৮টি কক্ষ আছে এবং প্রাসাদটির মেঝের (ফ্লার) আয়তন ১ লাখ ৩৫ হাজার বর্গ মিটার। মেঝের আয়তনের দিক থেকে এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় প্রাসাদের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই প্রাসাদেই স্পেনের রাজ পরিবারের বসবাস। রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান না থাকলে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ সজ্জা অত্যন্ত চমকপ্রদ। এর বিভিন্ন হল ও দেয়ালে প্রখ্যাত শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম টানানো আছে। এ ছাড়া এই রাজপ্রাাসাদে আরও ব্যয়বহুল এবং দুর্লভ সংগ্রহশালাও রয়েছে। কর্ডোবার উমাইয়াদ আমির প্রথম মুহাম্মদ ৮৬০-৮৮০ সালের মধ্যে এই প্রাসাদটি প্রথম নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে এর পুনঃনির্মাণ কাজ চলে।

পোতালা প্রাসাদ, চীন

ছবি: সংগৃহীত

পোতালা প্রাসাদটি চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বতের লাসায় অবস্থিত। এটি লাসা উপত্যকা থেকে ১৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ১৬৪৫ সালে পঞ্চম দালাই লামা এই প্রাসাদটির নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। প্রাসাদটি পূর্ব-পশ্চিম দিকে ৪০০ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণ দিকে ৩৫০ মিটার। প্রাসাদটি ভূমিকম্প সহনশীল উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে।

১৩ তলা প্রাাসাটিতে ১ হাজার কক্ষ, ১০ হাজার মঠ, ২ লাখ মূর্তি আছে। এই প্রাসাদে বহু দালাই লামার (তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা) বসবাস ছিল এবং বর্তমানে কয়েকজন দালাই লামার সমাধিও আছে এর আঙিনায়। বর্তমানে এই প্রাসাদটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ মূলত প্রার্থনা করতে এখানে যায়।

অনুবাদ করেছেন আহমেদ হিমেল

 

Comments