কালের সাক্ষী পুরান ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চ

আর্মেনিয়ান চার্চ
ছবি: ময়ূখ মাহতাব

আর্মেনিয়ান চার্চের অবস্থান পুরান ঢাকার আরমানিটোলায়। টোলা বলতে সাধারণত বাসস্থান বোঝানো হয়। আর আরমানি এসেছে আর্মেনিয় থেকে।

সতের শতকের শেষদিকের কথা। মোগল আমলের শেষদিকে ঢাকায় ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আসতে শুরু করেন আর্মেনিয়রা। তারা আজকের আরমানিটোলায় বাস করতে শুরু করেন। বাংলাপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, এখানে ছিল তাদের গোরস্থান ও ছোট একটি উপাসনালয়। ১৭৭৯ সালের দিকে জনৈক আগা মিনাস ক্যাটচিক এখানে গির্জা গড়ে তোলার জন্য জমি দান করেন। এই গির্জাটিই পরিচিত আর্মেনিয়ান চার্চ নামে।

জনশ্রুতি রয়েছে, চারজন আর্মেনিয় এখানে গির্জাটি গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। তারা হলেন মাইকেল সার্কিস, আগা এমনিআস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ ও মার্কার পোগোজ।

১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আর্মেনিয়ান চার্চ ঢাকায় আর্মেনিয়দের বসবাসের প্রতীক। কয়েকশ আর্মেনিয় তখন বাস করতেন এখানে। বাংলাপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, গির্জাটি নির্মাণ করেছিলেন জোহান কারু পিয়েত সার্কিস। ১৭৮১ সালে এর সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি ঘড়ি ঘরও। ১৮৯৭ সালের তীব্র ভূমিকম্পে ঘড়িঘরটি ভেঙে যায়।

আর্মেনিয়ান চার্চ
ছবি: জারীন তাসনিম মৌরি/ স্টার

গির্জাটি দৈর্ঘ্যে সাড়ে সাতশ ফুট। ২৭টি জানালা ও ৪ টি দরজা রয়েছে এতে। এর সঙ্গে গির্জায় ছিল প্রকাণ্ড এক ঘণ্টা। জনশ্রুতি আছে, এই ঘণ্টা বাজার শব্দ নাকি শোনা যেত চার মাইল দূর থেকেও। তবে ১৮৮০ সালে ঘণ্টাটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।

ঢাকায় আর্মেনিয়রা এসেছিলেন ভাগ্য অন্বেষণে। সংখ্যায় তারা কম হলেও ব্যবসার কারণে ছিলেন যথেষ্ট বিত্তবান। পাট, কাপড়, পানের ব্যবসায় বেশ নাম-যশ হয়েছিল তাদের। তবে তাদের মূল ব্যবসা ছিল লবণের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে থাকা একচেটিয়া এই ব্যবসার ঠিকাদারদের অধিকাংশই ছিলেন আর্মেনিয়। ঢাকায় প্রায় ১০-১২ ধরনের পদবির আর্মেনিয় পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়।

অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনের 'ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' বই থেকে জানা যায়, আর্মেনিয়দের পদবি ছিল আরাতুন, পোগোজ, মাইকেল, স্টিফান, লুকাস, পানিয়াটি, কোজা, মানুক, হার্নি, সিরকোর ও সার্কিস। সে সময়ে যথেষ্ট বিত্তের অধিকারী হওয়া আর্মেনিয়রা ঢাকায় জমিদারিও কিনেছিলেন। এরসঙ্গে দৃষ্টিনন্দন বাড়ি তৈরিও হয়েছিল তাদের তত্ত্বাবধানে।

আর্মেনিয়ান চার্চ
ছবি: জারীন তাসনিম মৌরি/ স্টার

বর্তমানে ওয়াইজঘাটে অবস্থিত বুলবুল ললিতকলা একাডেমী বা বাফার ভবনটি ছিল নিক পোগোজের। ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস ছিল আরাতুনদের নিবাস। স্টিফানরা থাকতেন আনন্দ রায় স্ট্রিটে।

১৮৫৬ সালে ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি চালু হয় সিরকোরদের হাতে। এক সময় ঢাকার প্রধান যানবাহনও হয়ে ওঠে এই গাড়ি। পরিচিত ছিল ঠিকা গাড়ি নামে। আর্মেনিয়রা বেশ পসার লাভ করেছিলেন চা ও মদ ব্যবসায়। এর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাদের সামাজিক প্রতিপত্তিও। নিকি পোগোজের হাত দিয়ে পোগোজ স্কুল গড়ে উঠে।

আরাতুন ঢাকার নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন। সার্কিস ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে স্থান পান। ১৮৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার নয়জন কমিশনারের ভেতর দুজন আর্মেনিয় স্থান পান। এতে তাদের সামাজিক প্রতিপত্তির জায়গাটি বোঝা যায়। উনিশ শতকের শেষদিক থেকে আর্মেনিয়রা ব্যবসার জন্য কলকাতামুখী হতে থাকলে ও ঢাকা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিলে এখানে তাদের প্রতিপত্তি কমতে থাকে।

আর্মেনিয়ান চার্চ
ছবি: প্রবীর দাশ/ স্টার

তবে আর্মেনিয়দের সংখ্যা তখনও কিন্তু খুব কম নয়। তাদের থাকার এই জায়গাটির নাম ব্রিটিশপূর্ব সময়ে ছিল আলে আবু সাইদ। সেটি পরিবর্তিত হয়ে আরমানিটোলা নামটিই স্থায়ী হয়। সে সময় এদিকে জনবসতি ছিল আজকের তুলনায় নিতান্তই কম।

গির্জাটির আশপাশজুড়ে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ কবর। গির্জায় প্রবেশের জন্য রয়েছে ১৪ ফুট প্রশস্ত এক বারান্দা। দালানের ভেতরে মেঝেকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি বেদি রয়েছে, যা রেলিং দিয়ে ঘেরা। মাঝখানের অংশে দুটি দরজা। তৃতীয় ভাগটি বেষ্টনী দিয়ে আলাদা করা। শুধু নারী ও শিশুদের বসার জন্য সংরক্ষিত।

গির্জার প্রার্থনাকক্ষের প্রধান প্রবেশদ্বারের একপাশে কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। এখান থেকে পাটাতনে উঠে যাওয়া যায়। একপাশে একটি বর্গাকার টাওয়ার চোখে পড়ে। গির্জার চূড়ায় চারটি শঙ্খ আকৃতির মিনার আছে। মাটি থেকে কয়েক ফুট ওপরে চার দেয়ালের মাঝে আছে একটি মার্বেল ফলক। এখানে আর্মেনিয় ও ইংরেজি ভাষায় রয়েছে উৎসর্গবাণী। এ থেকে জানা যায়, মিস্টার সার্কিস ঈশ্বরের উদ্দেশে এটি উৎসর্গ করেছেন। এই সার্কিসই সেই ব্যক্তি, যিনি চার্চের ঘণ্টা নির্মাণ করেছিলেন।

মুনতাসীর মামুনের লেখা থেকে আরও জানা যায়, উনিশ শতকের শেষদিকে আর্মেনিয়রা গির্জার ব্যয় কমানোর জন্য ঘণ্টাবাদককে বিদায় করে। এর ফলে ঢাকা প্রকাশ পত্রিকা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল।

গির্জাটি ভ্রমণে যারা আসেন, তাদের চোখে অবশ্যই পড়ে এখানে থাকা কবরগুলো। ১৮৭৬ সালে ৪৬ বছর বয়সে মারা যাওয়া নিক পোগোজের কবর রয়েছে এখানে। কোনো কবরে ধর্মীয় বাণী, কোনোটায় হৃদয় ছোঁয়া বাণী, তো কোনোটিতে খোদিত রয়েছে ভালোবাসা প্রকাশক কবিতা।

আর্মেনিয়ান চার্চ
ছবি: জারীন তাসনিম মৌরি/ স্টার

তবে আলাদাভাবে নজর কাড়ে ক্যাটাভিক এভাটিক টমাসের কবর। এই কবরটিই এখানকার একমাত্র কবর, যাতে ওবেলিক রয়েছে। এই কবরটির ওপরে একটি মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। কলকাতা থেকে সেটি কিনে এনেছিলেন টমাসের স্ত্রী। এই মূর্তিটি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে রয়েছে। আরেকটি কবরে দেখা যায়, স্বামীর স্মৃতির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে স্ত্রীর ইংরেজি কবিতা।

১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গে আর্মেনিয় বসবাস খুবই কমে আসে। ১৯৮৬ সালের পর আর্মেনিয় গির্জায় আর কোনো যাজক না থাকায় নিয়মিত প্রার্থনাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে সে সময় থেকে আর্মেনিয় মাইকেল জোসেফ মার্টিন এই কবরগুলো ও গির্জার দেখভাল করতেন। তার তিন মেয়ে ইলিয়ানোর, শেরিল ও ক্রিস্টিন মার্টিন।

শেরিল ও ক্রিস্টিন পরে কানাডা পাড়ি জমান। ২০০৫ সালের মে মাসে তার স্ত্রী ভেরোনিকা মার্টিনের মৃত্যু হয়। এটিই এখানকার শেষ আর্মেনিয় কবর।এরপরের ৯ বছর একাই কবরের দেখভাল করেন জোসেফ মার্টিন। ২০১৪ সালে কানাডায় মেয়েদের কাছে চলে যান তিনি। সেখানে ২০২০ সালের ১০ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়। এর মধ্য দিয়ে ঢাকার শেষ আর্মেনিয়েরও প্রস্থান ঘটে। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে গেছে এই গির্জা ও সমাধিগুলো।

 

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago