চোখে ভাসমান আকৃতি দেখা ও আলোর ঝলকানি কেন হয়, চিকিৎসা কী

জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি অফথ্যালমোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. শওকত কবীর।
আই ফ্লোটার্স
ছবি: সংগৃহীত

চোখে আলোর ঝলকানি বা আই ফ্ল্যাশ এবং বিভিন্ন আকৃতি দেখা বা আই ফ্লোটার্স অত্যন্ত বিরক্তিকর চোখের সমস্যা।

আই ফ্লোটার্স ও আই ফ্ল্যাশ সম্পর্কে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি অফথ্যালমোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. শওকত কবীর।

আই ফ্লোটার্স ও আই ফ্ল্যাশ কী

ডা. শওকত কবীর বলেন, আই ফ্লোটার্স ও আই ফ্ল্যাশ বয়সজনিত একটি পরিবর্তন। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের পর আই ফ্লোটার্স, আই ফ্ল্যাশ হতে পারে। তবে যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের এই বয়সের আগেও দেখা দিতে পারে।

মানুষের চোখের সামনের অংশে থাকে অ্যাকুয়াস হিউমার, তার পেছনে থাকে পিউপিল, লেন্স এবং তার পেছনে থাকে ভিট্রিয়াস হিউমার। ভিট্রিয়াস হিউমার এক ধরনের জেলি। এই জেলির মধ্যে যখন বয়সজনিত পরিবর্তন হয় তখন আই ফ্লোটার্স পরিলক্ষিত হয়। এর লক্ষণ হিসেবে কেউ কেউ চোখের ওপর মাছির মতো ঘুরতে দেখেন, কোনো আকৃতির মতো কিছু হতে পারে, আবার কেউ সুতার মতো দেখেন, কেউ কালো দাগ, কেউ অনেকগুলো দাগ দেখার কথা বলেন।

অন্যদিকে, চোখে ভিট্রিয়াস হিউমার বলে এক ধরনের জেলি বা থকথকে একটা বস্তু থাকে। বয়সের কারণে যখন পানির পরিমাণ বাড়ে এই বস্তুটি আরও তরল হয়ে যায়। তখন চোখে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, যার জন্য মানুষ বিদ্যুতের চমকের মতো বা আলোর ঝলকানি দেখে। এই সমস্যাকে আই ফ্ল্যাশ বলে।

ফ্লোটার্স ও আই ফ্ল্যাশের ঝুঁকি, কম বয়সীদের কেন হয়

ডা. শওকত কবীর বলেন, আই ফ্লোটার্স ও আই ফ্ল্যাশের তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। সাধারণত এগুলো দৃষ্টিশক্তি হ্রাস করে না বা দৃষ্টির ক্ষতি করে না। কিন্তু আই ফ্লোটার্স খুবই বিরক্তিকর। যেমন দেখা যায় কেউ হয়তো কাজ করছেন, তখন কম্পিউটারের মধ্যে কালো স্পটের মতো ঘুরছে। তখন সেটি কাজের ব্যাঘাত ঘটায়। আবার আই ফ্ল্যাশ অনেকের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ায়। কারণ আলোর ঝলকানিতে মনে হয় চোখের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকালো।

যদিও বয়সজনিত কারণে এগুলো হয়, তবে কম বয়সীদের মধ্যেও অন্যান্য রোগ বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে চোখের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আই ফ্লোটার্স, আই ফ্ল্যাশ আসতে পারে।

সামগ্রিকভাবে এগুলো ক্ষতি করে না। তবে যাদের ডায়াবেটিস আছে, উচ্চ রক্তচাপ বেশি থাকে তাদের জন্য আই ফ্লোটার্স ও আই ফ্ল্যাশ কিছুটা চিন্তার বিষয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে যদি চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় বা প্রেশার বেশি থাকার কারণে চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় তাহলে আই ফ্লোটার্স বাড়তে পারে। যদি আই ফ্লোটার্স, আই ফ্ল্যাশ বেশি হয় তাহলে অবিলম্বে চক্ষু চিকিৎসক বিশেষ করে রেটিনা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

আই ফ্লোটার্স বা আই ফ্ল্যাশের জন্য মাথা ব্যথা হয় না, মাথা ব্যথা হতে পারে যদি চশমার পাওয়ার পরিবর্তন হয় সেটার জন্য। এ ছাড়া যদি প্রেশার, ডায়াবেটিস বাড়ে সেক্ষেত্রে মাথা ব্যথা হতে পারে, দুর্বল লাগতে পারে।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যাদের জন্ম থেকে দৃষ্টিশক্তি কম, শৈশব থেকে চশমার অতিরিক্ত পাওয়ার থাকে তাদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা যায়। কারো যদি মাইনাস পাওয়ার বেশি অর্থাৎ হাই মায়োপিয়া থাকে, তাদের ক্ষেত্রে আই ফ্ল্যাশ হলে কোনো কোনো সময় রেটিনা ছিঁড়ে যেতে পারে। যদি কোনো শিশুর আই ফ্লোটার্স, আই ফ্ল্যাশের সমস্যা থাকে তাকে দ্রুত রেটিনা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কারণ যাদের মায়োপিয়া থাকে, চশমার অতিরিক্ত পাওয়ার থাকে তাদের রেটিনা সাধারণত দুর্বল হয়।

চিকিৎসা

ডা. শওকত কবীর বলেন, আই ফ্লোটার্স ও আই ফ্ল্যাশের সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। তাতে অন্তর্নিহিত কোনো কারণ আছে কি না সেটি বের করা সম্ভব হবে।

প্রথমে নির্দিষ্ট কী কারণে আই ফ্লোটার্স, আই ফ্ল্যাশ হচ্ছে সেটি শনাক্ত করতে হবে। যদি কোনো কারণ না থাকে তাহলে তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। রোগীকে আশ্বস্ত করা এবং ৬ মাস পর পর চোখ দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন জাতীয় মেডিসিন দেওয়া হয়, যেগুলোতে কিছুটা উন্নতি হয়।

বয়সজনিত যে আই ফ্লোটার্স হয়, সেটি আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে নিচের দিকে সেটেল করে, মাঝখানে না থাকলে রোগী আর তা খেয়াল করে না। তখন এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়।

আই ফ্ল্যাশের জন্য কোনো কোনো সময় রোগীকে নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি মেডিসিন দেওয়া হয়, যেটা আই ফ্ল্যাশ কমায়। নিয়মিত ওষুধ খেলে ফ্ল্যাশগুলো আস্তে আস্তে ২ থেকে ৬ মাসের মধ্যে চলে যায়।

আই ফ্লোটার্স, আই ফ্ল্যাশ সাধারণত নিজে থেকে চলে যায়। অন্ধত্বের তেমন কোনো ঝুঁকি নেই এবং চোখের স্থায়ী কোন ক্ষতি করে না। তবে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং চশমার হাই পাওয়ার আছে তাদের চোখে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেজন্য তাদের দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, ৩ থেকে ৬ মাস অন্তর ফলোআপ করতে হবে। চশমার হাই পাওয়ার থাকলে রেটিনা ছিড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে সার্জারির মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব।

এ ছাড়া যেসব শিশুদের জন্মগত মায়োপিয়া আছে, জন্মের পর মায়োপিয়া হয়েছে সেগুলো বিপজ্জনক। তাদের চশমার অতিরিক্ত পাওয়ার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেটিনা পরীক্ষা করতে হবে। রেটিনায় দুর্বল জায়গা থাকে যেগুলো আই ফ্লোটার্স ও ফ্ল্যাশ তৈরি করবে, সেটাকে রেটিনাল রিজেনারেশন বলে। বিভিন্ন ধরনের রিজেনারেশন থাকে। ওগুলোতে প্রয়োজনে লেজার করে দেওয়া হয় পরবর্তী বিপদ থেকে সুরক্ষার জন্য। যাদের চশমায় অতিরিক্ত পাওয়ার তাদের বছরে ৩ বার চোখের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এতে রেটিনায় কোনো পরিবর্তন হলে সেটি শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

 

Comments