চোখেও হয় স্ট্রোক, লক্ষণ ও চিকিৎসা কী

চোখের স্ট্রোক
ছবি: সংগৃহীত

চোখের স্ট্রোক অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চোখের স্ট্রোক হওয়ার পরেও অনেকেই তা বুঝতে পারেন না।

চোখের স্ট্রোক সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি অপথালমোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. শওকত কবীর।

চোখের স্ট্রোক কী

অধ্যাপক শওকত কবীর বলেন, চোখের স্ট্রোক বলতে বোঝায় চোখের রক্তনালীর সমস্যা, বিশেষ করে চোখের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়াকে। ২ ধরনের রক্তনালী আছে। যেমন- রেটিনাল আর্টারি বা ধমনী এবং রেটিনাল ভেইন বা শিরা। রেটিনাল ধমনী ও রেটিনাল শিরায় যদি সমস্যা হয় তখন তাকে চোখের স্ট্রোক বলা হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় চোখের স্ট্রোককে রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন বা রেটিনাল ভেইন অক্লুশন বলে। চোখে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী বা শিরা যদি বন্ধ হয় তাহলে চোখে স্ট্রোক হয়। চিকিৎসা না করলে চোখের দৃষ্টিশক্তি চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে চোখের স্ট্রোক থেকে। এতে কোনো ধরনের ব্যথা হয় না, চোখের দৃষ্টি অবশ হয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়, ঝাপসা হয়ে যায়। দৃষ্টিশক্তি সামান্য থেকে মারাত্মক পর্যায়ে হ্রাস পেতে পারে।

ধরন

চোখের স্ট্রোকের ব্লকেজের ওপর ভিত্তি করে স্ট্রোকের ধরন ভাগ করা হয়। যেমন-

সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন: রেটিনার প্রধান রক্ত সরবরাহকারী যে প্রধান ধমনী, সেটি যদি অবরুদ্ধ হয়ে যায় তাকে সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন বলে। এর ফলে হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি মারাত্মক হ্রাস পায়।

ব্রাঞ্চ রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন: চোখের ধমনীর ছোট একটি অংশ বা প্রধান ধমনীর কোনো একটি শাখা যদি ব্লক বা বাঁধা সৃষ্টি হয় তাহলে তাকে ব্রাঞ্চ রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন বলে। এক্ষেত্রে আংশিক দৃষ্টি হ্রাস পায়, আংশিক দৃষ্টি প্রভাবিত হয়।

সেন্ট্রাল রেটিনাল ভেইন অক্লুশন: রেটিনার প্রধান শিরা যদি অবরুদ্ধ বা বন্ধ হয়ে যায় তাকে সেন্ট্রাল রেটিনাল ভেইন অক্লুশন বলে।

ব্রাঞ্চ রেটিনাল ভেইন অক্লুশন: শাখা শিরাতে ব্লক হলে তাকে ব্রাঞ্চ রেটিনাল ভেইন অক্লুশন বলে।

লক্ষণ

১. চোখের স্ট্রোকে খুব বেশি ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এমন উপসর্গ থাকে না।

২. যদি মাত্রা কম থাকে তাহলে চোখে বিভিন্ন আকৃতি, ধূসর দাগ দেখবে রোগী যেটাকে আই ফ্লোটার্স বলা হয়।

৩. যদি মাত্রা বেশি হয় তাহলে দৃষ্টি তীব্রভাবে ঝাপসা হবে অথবা চোখের দৃষ্টির একাংশ ঝাপসা হয়ে যেতে পারে অথবা পুরো অংশ ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।

৪. দৃষ্টিশক্তি সূক্ষ্ম থেকে গুরুতর হ্রাস পাবে। সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন হলে দৃষ্টিশক্তি আকস্মিকভাবে হ্রাস পায়, আবার ভেইন অক্লুশন হলে ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়।

৫. সেন্ট্রাল রেটিনাল ভেইন অক্লুশন হলে চোখে চাপ বা অস্বস্তি অনুভূত হয়।

৬. সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন হলে কেন্দ্রীয় দৃষ্টি নষ্ট হয় অর্থাৎ চারপাশে ভালো থাকে কিন্তু মাঝখানে দেখবে না।

চোখের স্ট্রোক হলে অনেকে বুঝতেও পারেন না, কোনো সমস্যায় চোখ পরীক্ষা করতে গেলে সমস্যাটি শনাক্ত হয় ।

চোখের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকির কারণ

১. যাদের বয়স বেশি বিশেষ করে যাদের বয়স ৬০ এর বেশি তাদের চোখের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। নারীদের তুলনায় পুরুষদের ঝুঁকি বেশি।

২. যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, কোলেস্টরেলের মাত্রা বেশি, ডায়াবেটিস বেশি এবং দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস আছে।

৩.  যাদের হার্টের সমস্যা আছে, করোনারি হার্ট ডিজিজ আছে।

৪.  রক্তনালীর সমস্যা ক্যারোটিড আর্টারি ডিজিজ যদি থাকে, তাদের চোখের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

৫. যদি কারো আগে ব্রেইন স্ট্রোক এর ইতিহাস থাকে তাদের ঝুঁকি বেশি।

৬. গ্লুকোমা আছে যাদের।

৭. যাদের রক্তের ক্যানসার বা লিউকোমিয়া আছে, যদি খুব বেশি রক্তশূন্যতা থাকে তাদের চোখের স্ট্রোক হতে পারে।

৮. রক্তের কিছু রোগ আছে যেগুলোর কারণে রক্তের প্রবাহ কমে যায় হাইপারভিসকোসিটি বলে, সেটির কারণেও হতে পারে।

৯.  ধূমপায়ী ব্যক্তি, ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি কম করেন যারা তাদেরও ঝুঁকি বেশি।

চিকিৎসা

অধ্যাপক শওকত কবীর বলেন, যেহেতু চোখের স্ট্রোকে চোখের রক্তনালীতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, সেহেতু রক্তপ্রবাহ কিভাবে পুনরুদ্ধার করা যায় সেটির ব্যবস্থা করাই মূল কাজ। যদি সেন্ট্রাল রেটিনাল আর্টারি অক্লুশন হয় এটাকে চোখের জরুরি অবস্থা বলে। যদি কারো হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি কমে যায় তাহলে তাকে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে রেটিনা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। চোখের কোন রক্তনালী বন্ধ হয়েছে, চোখে পানি জমেছে কিনা, চোখে কী পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়েছে, কী ধরনের চোখের স্ট্রোক হয়েছে ধমনীর নাকি শিরার এসব কিছু নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক চিকিৎসা শুরু করবেন। একইসঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ চোখের স্ট্রোক হতে পারে এমন অন্যান্য রোগেরও পরীক্ষা করতে হবে।

চোখের স্ট্রোকে চিকিৎসা হিসেবে রক্তপ্রবাহ পুনরুদ্ধারে চোখে ইন্টারমিটেন্ট ম্যাসেজ দেওয়া হয়, এর মাধ্যমে রক্ত জমাট বাঁধা জায়গা ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কোনো কোনো সময় চোখের চাপ কমানোর জন্য প্যারাসেন্টেসিস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গ্লুকোমা কমায়, ক্লট ছাড়ায় এ জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে। কিছু ক্ষেত্রে অক্সিজেন থেরাপি দেওয়া হয়। অনেক সময় রক্তক্ষরণ হয় পুরো রেটিনা জুড়ে সেই রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য এবং চোখের ম্যাকুলায় যদি পানি জমে সেই পানি কমানোর জন্য কিছু ইনজেকশন দেওয়া হয়।

প্রতিরোধ

১.ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টরেল, গ্লুকোমা থাকলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

২.হৃদরোগ থাকলে তার সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে।

৩. নিয়মিত ব্যায়াম করলে রক্তনালীর প্রবাহ ভালো থাকে। সেজন্য নিয়মিত ব্যায়াম ও হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।

৪. প্রচুর শাকসবজি, ফল খেতে হবে এবং চর্বিবিহীন প্রোটিন খেতে হবে। ভাতের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না।

৫. ধূমপান, অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে।

৬. যাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের প্রতি ৬ মাস থেকে ১ বছর পরপর অবশ্যই একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ অথবা রেটিনা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English
Strategies we can employ in tariff talks with the US

Strategies we can employ in tariff talks with the US

We must realise that the US has started the tariff war with a political agenda.

5h ago