মাইলস্টোন কিংবা যেকোনো দুর্ঘটনায় পিটিএসডি-ঝুঁকি: লক্ষণ কী, প্রতিরোধে করণীয়

পিটিএসডি,
ছবি: সংগৃহীত

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি দীর্ঘমেয়াদি একটি মানসিক প্রতিক্রিয়া। রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের মতো ঘটনা পিটিএসডি ঝুঁকি বাড়ায়।

পিটিএসডি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

পিটিএসডি কী, কেন হয়

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, যেকোনো ট্রমার পরবর্তী যে লক্ষণগুলো হয়, তাকে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি বলা হয়। পিটিএসডিকে অনেক সময় ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, যেমন: ট্রমার পরপর হওয়া লক্ষণগুলোকে অনেকে পিটিএসডি বলে থাকেন। কিন্তু পিটিএসডি ট্রমার পরপরই হয় না। ট্রমার পরপর তাৎক্ষণিক যে লক্ষণ প্রকাশ পায়, সেটি হচ্ছে অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার।

পিটিএসডি হচ্ছে ট্রমার দীর্ঘমেয়াদি একটি মানসিক প্রতিক্রিয়া, যা এক ধরনের মানসিক রোগ। যেকোনো ট্রমার কমপক্ষে দেড় মাস থেকে শুরু করে ছয় মাস পরে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, সেটিই হচ্ছে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার।

যেকোনো ট্রমায় পিটিএসডি হবে না। সাধারণত ছোটখাটো ট্রমায় পিটিএসডি হয় না। বড় কোনো দুর্ঘটনার পর সাধারণত যারা দুর্ঘটনাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে, দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছে, দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল—তাদের মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের লক্ষণ বেশি দেখা দিতে পারে।

প্রিয়জন বা আত্মীয়-স্বজন কারো যদি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়, সরাসরি বড় কোনো দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে, বড় ধরনের কোনো হয়রানি, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, হত্যা, নির্যাতন, নৃশংসতা, বীভৎসতার মুখোমুখি হওয়ার মতো ভয়াবহ কোনো ঘটনার দেড় থেকে ছয় মাস পরে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি হয়।

লক্ষণ

১. ফ্ল্যাশব্যাক হওয়া, ট্রমার স্মৃতি ফিরে আসা। বিশেষ করে ট্রমা যে স্থানে হয়েছিল তার কাছাকাছি গেলে, দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ উঠলে, ট্রমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো কথা, ট্রমার তারিখ ঘনিয়ে আসলে তখন ফ্ল্যাশব্যাক হবে। ফ্ল্যাশব্যাক হলে ট্রমার সময় যে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেরকম অভিজ্ঞতাই তার মধ্যে প্রকাশ পায়।

২. হতাশা, বিষণ্ণতা তৈরি হয়, আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়।

৩. ট্রমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কথা, ব্যক্তি, জায়গা, ঘটনা অর্থাৎ ট্রমা মনে করিয়ে দিতে পারে এমন সবকিছু এড়িয়ে চলে। ট্রমার স্মৃতি ভুলে থাকতে চায়।

৪. আক্রান্ত ব্যক্তি অতি সর্তক অবস্থায় থাকে, সবসময় তটস্থ থাকে, সহজেই চমকে ওঠে, সবসময় পেছন ফিরে দেখে কেউ তাকে দেখছে কি না, কিছু হচ্ছে কি না, অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে ওঠে।

৫. তার সঙ্গে ট্রমার ঘটনা ঘটেছে এমনটা বিশ্বাস করতে চায় না, অনেক সময় নিজেকেই দায়ী করে সবকিছুর জন্য।

৬. ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, দেখা যায় ঘুম আসে না আবার ঘুম এলেও ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে যায়।

বড় ধরনের ট্রমা প্রত্যক্ষ করলেই সবার পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হবে—এমনটা নয়। খুব অল্প সংখ্যকের মধ্যে পিটিএসডি হয়। ট্রমার পরে সামাজিক, পারিবারিক সহায়তা না পাওয়া, আঘাত পাওয়ার পর চিকিৎসার অভাব, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কাউকে বলতে না পারা কিংবা সমর্থন না পাওয়া, যাদের আবেগীয় বিকাশের জায়গাটি দুর্বল তাদের ভেতর পিটিএসডি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

চিকিৎসা

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, মনো-দৈহিক-সামাজিক পদ্ধতিতে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে হবে। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন রিপ্রসেসিং থেরাপি (ইএমডিআর), লং টার্ম এক্সপোজার থেরাপির মাধ্যমে পিটিএসডির চিকিৎসা দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হয়।

রোগীকে মানসিকভাবে সমর্থন দিতে হবে, কাউন্সিলিং করতে হবে, সাইকোথেরাপি দিতে হবে এবং প্রয়োজনে ওষুধ খেতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। একইসঙ্গে সামাজিক সমর্থন, সহযোগিতাও দিতে হবে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সামরিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ট্রমার প্রভাব

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সামরিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে থাকা মানুষেরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার যেকারো হতে পারে। সামরিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে দগ্ধ হয়েছে, আহত হয়েছে কিংবা আহত না হলেও সরাসরি দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে যেসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা, তাদের পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

এছাড়াও পিটিএসডি হতে পারে উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে যারা দগ্ধ ও মৃতদের উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ছিলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে যারা তাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন, গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে যারা সরাসরি সংবাদ করেছেন, অভিভাবক, এমনকি দূরবর্তী একজন মানুষ যে ঘটনাস্থলে ছিল না, কিন্তু টেলিভিশন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দেখেছে, ঘটনাগুলো পড়েছে এমন ব্যক্তিদেরও পিটিএসডি হতে পারে।

করণীয়

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার প্রভাবে পিটিএসডি যাতে না হয়, সেজন্য সবাইকে প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দিতে হবে, এর তিনটি স্টেপ রয়েছে। যেমন:

১. দেখা বা পর্যবেক্ষণ: পরিস্থিতি ও আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাদের সহায়তা প্রয়োজন তাদের দেখতে হবে।

২. শোনা: মনোযোগ দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির কথা শুনতে হবে, তার অনুভূতি বুঝতে হবে।

৩. সংযুক্ত করা: সামাজিক সংযোগ তৈরি করতে হবে, শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতে হবে, শিক্ষকদের কর্মস্থলে পাঠাতে হবে। এই সংযুক্ত করার কাজটি করতে হবে ধীরে ধীরে, তাড়াহুড়ো করে নয়।

ঘুমের সমস্যা হলে তা ঠিক করতে হবে, ধীরে ধীরে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দিতে হবে। স্বাভাবিকীকরণ অর্থাৎ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা করতে হবে। আর যদি কারো মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

India imposes immediate ban on jute product imports from Bangladesh via land ports

The goods are bleached and unbleached woven fabrics of jute or other bast fibre, twine, cordage and cables of jute besides sacks and bags of jute

2h ago