রাজনীতি ভেঙে দিচ্ছে সম্পর্ক, নির্বাচনে বাড়ছে বিভক্তি
জাতীয় নির্বাচন আসন্ন কিন্তু গ্রামে উৎসবের আমেজে নেই বললেই চলে। একসময় নির্বাচন ঘিরে গ্রামে আনন্দ, উন্মাদনা ও উত্তেজনা ছিল। সেই প্রবাহ আজ বিলুপ্ত প্রায়। বেশির ভাগ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। গণপ্রত্যাহার বলা যায়। কারণ, রাজনীতি করার পরিসর আজ সুস্থ ও সবল নেই।
রাজনীতি ও নির্বাচন ঘিরে বরেন্দ্রের একখণ্ড জনপরিসরে নিরুত্তাপ পরিস্থিতি দেখে এলাম। গ্রামের রাজনীতির গতিধর্ম বদলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নির্লিপ্ততা বাড়ছে। কারণ, চারপাশে ভয় প্রসারিত হচ্ছে। রাজনীতির মহাসড়ক দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেছে প্রবল ভয়। এই নিয়ে খোলামনে কথা বলছেন না কেউ। অথচ গ্রামগুলো ছিল রাজনৈতিক সচেতনতার এক বিশেষ পরিসর।
রাজনীতি কেবল ব্যক্তি নিষ্ক্রিয়তাকে উজ্জীবিত করছে না সামাজিক অস্থিরতা ও বিভক্তি তীব্র করছে। রাজনীতি আজ সখ্যের সালুন নয়, বিভক্তির হেতু। এ বিভক্তি কেবল সমাজের অন্তঃস্রোতে বহমান নয়, ঘরে ঘরে-অসম্পর্ক, ক্লেদ, হানাহানি আর প্রত্যাখ্যান প্রকটিত।
রাজনীতির মতো শুদ্ধাচার কালিমালিপ্ত হলো। রাজনীতির শরীর থেকে সরে গেলো জনকল্যাণব্রত, সংযুক্তি ও অগ্রসরতা। রাজনীতি এখন সামষ্টিক মুক্তির উপলক্ষ নয় বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সমৃদ্ধতার কারক। হালজামানার রাজনীতির কাছে গণমানুষ হেরে যাচ্ছে, জিতে যাচ্ছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষ।
খ
শহর কেবল বিভক্ত রাজনীতির ক্ষেত্র নয় একই আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে গ্রাম। কারণ, গ্রাম হাঁটছে শহরের পথ ধরে। আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে গ্রামে। এ এক বিশেষ রাজনৈতিক অঙ্গীকার। শহরের বিভক্ত রূপ গ্রামও স্পর্শ করছে দারুণ উপমায়। শহর-গ্রাম মিলে বিভক্ত সমাজের শক্ত ভিত রচিত হচ্ছে। দেশ হয়ে উঠছে একদলা বালির মতো সম্পর্কহীন । পাশাপাশি অবস্থান করেও কারো সঙ্গে কোনো সংগতি নেই। অথচ দরকার ছিল এঁটেল মাটির মতো অচ্ছেদ্য এক দলা এক শক্ত বন্ধন।
২৫-৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ রাজশাহীর তানোর উপজেলার কালীগঞ্জ ও মুণ্ডুমালা হাট, সরনজাই, মোহাম্মদপুর, তাঁতিহাটি, শিবরামপুর, সরকারপাড়া এবং গোদাগাড়ী উপজেলার পলাশী, আলোকছত্র, প্রসাদপাড়া, বাবুপুর, রিশিকুল ও খড়িয়াকান্দি গ্রাম ঘুরে সমকালীন গ্রাম রাজনীতির কিছু প্রবণতা চোখে পড়লো। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া কয়েকটি বিশেষ দিক নিচে তুলে ধরা হলো-
ভিনদেশি রাজনীতি আপন, পর হলো স্বদেশী
প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের সঙ্গে মানুষে আন্তঃসংযোগ বেড়েছে। মানুষ কেবল এখন একান্ত জীবনযাপন করে না, একসঙ্গে অনেকের জীবনযাপন করে। আপন জয়-পরাজয়,ব্যথা-বেদনায় নিয়ে যেমন উল্লসিত বা উদ্বিগ্ন তেমনি বিশ্বপরিসরে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সে সমব্যথী।
গ্রামপর্যায়ে যুথবদ্ধজীবনের গল্প ক্ষেত্র হলো চাস্টল, খোলারমাঠ বা মুক্তপ্রাঙ্গন। স্টলগুলোতে গাজা পরিস্থিতি, আমেরিকা ও রাশিয়ার নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের সন্তান সাহিত্যিক মঈন শেখ জানালেন, বরেন্দ্রের কৃষক রাজনীতি বিষয়ে বেশ সচেতন ক্ষেতের কাঁচা কাদা কানে লাগিয়ে চাস্টলে বসে তারা ডোনাল্ড ট্রাম নিয়ে আলাপ করেন। অন্য দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে ঝুঁকি অনুভব করে না। কিন্তু নিজ দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে ভয় পায়।
গ্রামের মানুষ ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নামও জেনে গেছে। গাজায় শিশুদের ওপর আক্রমণে তারা উৎকণ্ঠিত। জাতিসংঘের অক্ষমতা ও বিশ্ব মোড়লদের নিষ্ক্রিয়তায় তারা ক্ষুদ্ধ। এ বিশ্লেষণাত্মক গ্রামীণ জনসমাজ বিদেশি ইস্যুতে কথা বলতে যতোটা স্বাচ্ছন্দ্য ততটাই দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে সংকোচ।
এক অজানা আশংকা তাদের তাড়া করে ফিরছে। নানা বিষয়ে তারা কথা বলছেন কিন্তু নির্বাচন, প্রার্থীতা, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কথা বলতে উৎসাহ পাচ্ছে না। পলাশীতে একজন জানালেন-কয়েকদিন আগে আলোকছত্র গ্রামের চাস্টল থেকে পুলিশ একজনকে ধরে নিয়ে গেছে। এখনো জামিন হয়নি। জানি না কবে হবে? এর পেছনে রয়েছে ঔ পঙ্কিল রাজনীতি।
প্রসাদপাড়ায় কথা হচ্ছিল স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি সঙ্গে; তিনি জানালেন- ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ জনগণ উৎসবের আমেজে নির্বাচন, তর্কবিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা করেছে। পক্ষ-প্রতিপক্ষ বসে একসঙ্গে চা খেয়েছে, কথা বলেছে। সহনশীলতা ছিল। সেই পরিস্থিতি নেই আজ। সামাজিক সম্পর্কে চরম বিভক্তি ঘটেছে। সহনশীলতা, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই বললেই চলে। বহুমাত্রিক সমাজ একরৈখিকতার পথ ধরেছে। আগের দিনগুলোর অবস্থান এখন জনস্মৃতিতে।
নিবিষ্টতা আর বেড়েছে রাজনৈতিক নির্লিপ্ততা
শীত ও রাজনৈতিক উত্তাপ মিলিয়ে নির্বাচন হতো আনন্দের বিশেষ উপলক্ষ। নির্বাচন ছিল সর্বজনীন উদযাপন। মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা, সভা-সমিতি অংশ নিতো। সংযুক্তিপনা বাড়াতো। সে জনঅভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। রাজনৈতিক স্থবিরতা বেড়েছে।
মানুষ রাজনৈতিক তৎপরতার চেয়ে নিজ কাজে অনেক বেশি নিবিষ্ট হয়েছে। রিশিকুল গ্রামের একজন কৃষক জানালেন- চার বিঘা জমিতে তিনি আলু চাষ করেছেন। আলুর ক্ষেতে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ভোট দিতে যাবেন কিনা সিদ্ধান্ত নেননি। ভোট দিতে আগ্রহও পাচ্ছেন না। তিনি আরও জানালেন- তাঁর ভাগ্য ক্ষেতে, ক্ষেতে তার ভাগ্য বোনা। রাজনীতি তাঁকে টানে না।
জনপরিসরে আধেয় বদলে গেছে
মানুষের আলাপ-আলোচনা আড্ডাস্থল তার পরিসর। জনপরিসর হলো- চাস্টল, সেলুন, নদী-ঘাট, পুকুরপাড়, খোলাপ্রান্তর, উন্মুক্তমাঠ। এসব জনপরিসরের আধেয় বদলে যাচ্ছে। নানা তর্কেবির্তকে জমে উঠা চাস্টলগুলো আজ রাজনৈতিকভাবে আধেয়হীন। সেখানে সামাজিক সম্পর্কের নানাপ্রকরণ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে কেবল রাজনীতি ছাড়া।
মানুষ মুখবুজে চা খাচ্ছে, বিস্কিট খাচ্ছে। খড়িয়াকান্দি সেতুর পাশে চা দোকানীর হুশিয়ারি স্টলে রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন না। ভোট নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। যারা ভোট নিয়ে কথা বলতে চান তারা বাইরে গিয়ে আলাপ করেন। দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম, কথা বললে সমস্যা কোথায়? দোকানীর উত্তর-সমস্যা আছে। সবার হাতে মোবাইল। অনেকে কথা রেকর্ড করে, জায়গা মতো পাঠিয়ে দেয়। অনেক সময় ঝামেলা বাঁধে। ব্যবসা সামলাবো না এগুলো দেখবো?
গ্রামপরিসরে মোবাইল প্রযুক্তি গোপনীয়তার সংস্কৃতির ভেঙে দিচ্ছে। মোবাইলের ব্যবহার ও অপব্যবহার দুটোই বেড়েছে। কে কোথায়, কী উদ্দেশ্যে, কী রেকর্ড করছে তা বোঝা যায় না। প্রযুক্তির অপব্যবহারে পারষ্পরিক আস্থাহীনতা বাড়াচ্ছে।
মোবাইল প্রযুক্তি কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের অর্থাৎ নেতার সঙ্গে কর্মীর সংযোগ ও যোগাযোগ সহজ করেছে। কর্মীরা নিবিড় যোগাযোগের আওতায় এসেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক যোগাযোগ মানবীয় যোগাযোগের গণ্ডি ভেঙে দিচ্ছে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ ঘনত্ব বেড়েছে বহুগুণ।
চাস্টলের মালিকদের রাজনৈতিক পক্ষপাত সমমনাদের এক জায়গায় সমবেত হতে উদ্বুদ্ধ করছে। এ বিভক্তি দৃশ্যমান সহজেই চোখে পড়ে। বিয়ে-শাদি, সামাজিক উপলক্ষ, ধার-কর্জ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব-পার্বণ রাজনীতির প্রভাব মুক্ত নয় ।
গ্রামের মানুষেরা দুধরনের সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। এক. সামাজিক সম্পর্ক, দুই. রাজনৈতিক সর্ম্পক। গ্রামের মানুষ সামাজিক সম্পর্ক সুরক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক সম্পর্ক সুরক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর পেছনে মূলত কাজ করছে নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব। মানুষ নিরাপদ ও ঝক্কিহীন জীবনযাপন করতে চায়। এ জন্য রাজনীতিপনা লাগছে। রাজনীতিপনার সঙ্গে মূল্যবোধের বিশেষ সম্পর্ক নেই, রয়েছে স্বার্থপরতা ও আচারসর্বস্বতা। মানুষ নিজে নিজে প্রশিক্ষিত হয়ে সম্পর্কগুলো রক্ষা করছে দারুণ ভঙ্গিমায়।
একপাক্ষিক প্রচারের আধিক্য
নির্বাচন ঘিরে ভোটারেরা রাজনৈতিক যোগাযোগের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এবার জাতীয়-গ্রামপর্যায়ে প্রচারে একধারার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছ তা হলো ''জয় বাংলা, জিতবে এবার নৌকা''। নির্বাচনী প্রচারে অন্যপ্রার্থীদের কণ্ঠস্বর দশ ভাগ হলে নৌকা প্রতীকের প্রচার ৯০ ভাগ। পোস্টার ও লিফলেট প্রচারে কিছুটা ভারসাম্য থাকলেও মাইকিং বা মোড়ে মোড়ে সাউন্ডসিস্টেম ব্যবহার করে প্রচার-প্রচারণার নৌকা অস্বাভাবিক মাত্রায় এগিয়ে আছে।
''জয় বাংলা, জিতবে এবার নৌকা'' সুর-ছন্দ, মিউজিক ও উপস্থাপনা নিয়ে বাজারে চাস্টলে কয়েকজন কলেজ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। প্রচার সম্পর্কে তাদের মতামত-এ গানের সুরের ভেতর রয়েছে মাদকতা-উত্তেজনা, মজা এবং গতি ও তরুণদের আকর্ষণের বিশেষ মনস্তত্ত্ব।
আধুনিক ঢং-এ গাওয়া এ গান বারবার শুনলেও বিরক্ত লাগে না। গানের কোনো কোনো অংশ প্রত্যাখানবোধ জাগলেও অবশেষে গানটি উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তাদের ধারণা এ গান যিনি বেঁধেছেন তাকে অনেক টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছে। কারণ এ গান নির্বাচনী প্রচারণায় বেশ কাজে লাগছে।
ইস্টেবলিস্টমেন্ট বিরোধীতা
তানোর-গোদাগাড়ী-১ সংসদীয় আসন-৫২-তে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনো প্রার্থী নেই। রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী একাধিক প্রার্থী যারা বিভিন্ন প্রতীকী নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বর্তমান সংসদ সদস্য পরপর তিনবার এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। যারা ভোট কেন্দ্রে যেতে চান তাদের মধ্যে ইস্টেবলিস্টমেন্ট বিরোধীতার ঘ্রাণ পাওয়া গেল। তারা সীমিত সুযোগ থেকে নতুন বিকল্প নির্ধারণের কথা ভাবছেন। কিন্তু তাদের সন্দেহ তাদের ভোটের দাম থাকবে কী না? তাদের মতামতের যথাযথ মূল্যায়ন হবে কী না? নিষ্কণ্টক, সংশয়হীন ভোটের মাঠ চোখে পড়লো না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বরং বাড়ছে সামাজিক বিভক্তি।
মনে রাখা দরকার, গ্রামপরিসরে ক্লেদাক্ত রাজনীতি ক্ষয় ও ক্ষরণ থেকে মুক্তি দরকার। ব্যক্তি বা সামাজিক সম্পর্কের বিস্তর বিভক্তি নিয়ে একটি সমাজ এগুতে পারে না। সহাবস্থান, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভিন্নমত ও বৈচিত্র্যের প্রতি আনুগত্য ছাড়া কীভাবে নির্মিত হবে উন্নত সমাজ? বাংলাদেশ একটি বড় গ্রাম। গ্রামের সৌহার্দ্য ও সম্প্রতি ভেতর বাঁচতে পারে বাংলাদেশের গতিশীল সত্তা।
Comments