মানবিক মানুষ কামাল লোহানী
লোহানী চাচাকে কতো দিন ধরে চিনি, চিন্তা করলে পূর্বপাকিস্তান আমলে চলে যেতে হয়। চাচা আমার বাবার (কবি নওশাদ নূরী) বন্ধু ছিলেন। তাছাড়া তারা এক সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। এটি ১৯৬৭ সাল হবে। আমার বাবা বাসায় সবসময় লোহানী চাচার কথা বলতেন এবং তার গল্প করতেন।
চাচাকে দেখার প্রথম স্মৃতি আমার কাছে একজন বিদ্রোহী হিসেবে। লাহোর থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো নাম ছিল "লায়েল ও নাহার"। ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। আইয়ুব খান তখন প্রেস অর্ডিন্যান্স বিল পাস করে সংবাদপত্রের উপর একরকম চাপ সৃষ্টি করে ছিলেন। ওই "লায়েল ও নাহার" পত্রিকার একটি সংকলনের প্রচ্ছদে একটি বড় ছবি ছাপা হয়েছিল যেটা ছিল লোহানী চাচার। তিনি হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছেন পিছনে একটি প্ল্যাকার্ড ছিল। যেখানে একজন লোকের ঠোঁটে তালা ঝুলছে। চাচার ওই ভঙ্গী, অগ্নিঝরা চোখের চাহনি আজও ভুলতে পারিনি।
বাবা গল্প করতেন যে লোহানী খুব ভালো নাচ জানে এবং অফিসে আদীব সোহেল সেতার বাজায় আর লোহানী নাচে। তাঁর একটি নাচের দলও ছিল। যেটা নিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করার জন্য যেতেন। চাচা অনেক লম্বা ছিলেন আর মাথা ভর্তি ঘন চুল যেটা শেষ পর্যন্ত একই রকম ছিল। অনেক লম্বা আর খুব হ্যান্ডসাম ছিলেন। তিনি গল্প করতেন যে তাদের পূর্বপুরুষ লোহান থেকে এসে ছিলেন যেটা আফগানিস্তানে অবস্থিত। তাদের নাম ওই লোহান থেকে লোহানী হয়েছে। তাকে দেখতে কিন্তু পাঠানের মতই মনে হতো। তিনি অনেক আন্তরিক আর মনের মতো পরিবেশ পেলে অনেক গল্প করতেন।
বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু অবতরণ করেন ১০ জানুয়ারি। দিনটি ভুলার মতো নয় আর ভুলতে পারবো না। কারণ ওই আগমনের ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন চাচা। তার দরাজ কণ্ঠ, তাঁর আবেগ মিশানো ভাষা, তার উল্লাস আমি আজও ভুলতে পারিনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। মনে আছে আমার বাবা সন্ধ্যা সময় চুপিচুপি কানে রেডিও লাগিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতেন। বিশেষ করে লোহানী চাচার অনুষ্ঠানগুলো শুনতেন। স্বাধীন বেতারে আমার বাবার আর একজন বন্ধু ছিলেন জাহিদ সিদ্দিকী, তিনি উর্দু সার্ভিসে কাজ করতেন। বাবা আবার চাচি দীপ্তি লোহানীও অনেক ভক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে বাবা তাদের খোঁজ খবর রাখতেন। চাচা ৯ মাস কলকাতায় ছিলেন আর শব্দ সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। তখন আমরা যারা দেশে ছিলাম তাদের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার একটি সাহস সঞ্চারের মাধ্যম ছিল, মনোবল বাড়িয়ে দিতো এবং পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকার, রেডিও আর টেলিভিশনের একতরফা সংবাদ ছাড়াও কিছু বাস্তবধর্মী সংবাদ পেতাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এলেন। তিনি ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে, লন্ডন আর দিল্লী হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু অবতরণ করেন ১০ জানুয়ারি। দিনটি ভুলার মতো নয় আর ভুলতে পারবো না। কারণ ওই আগমনের ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন চাচা। তার দরাজ কণ্ঠ, তাঁর আবেগ মিশানো ভাষা, তার উল্লাস আমি আজও ভুলতে পারিনি। ওই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। পরে চাচা বাংলাদেশ বেতারে চাকরি পেলেন কিন্তু খুব বেশী দিন টিকতে পারেননি। আমলাতন্ত্রের কলাকৌশল রপ্ত করতে পারেননি এবং পারবেনই বা কী করে সারাজীবন কেটেছে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
মনে পড়ে ১৯৭৪ সালের কথা। মওলানা ভাসানী অনশন করলেন। তখন ন্যাপের অফিস ছিল মতিঝিলে। ওই অফিসেই অনশন। দুনিয়ার লোকজন উনাকে দেখতে আর সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য যেতো। কি নিয়ে এই অনশন ছিল আমার এখন কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে আমার বোনরা উনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে লোহানী চাচাও ছিলেন। বাবাও ছিলেন। কিছুক্ষণ মাওলানা ভাসানীর আশে পাশে থেকে, উনার মাথা, হাত পা টিপে দিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
মা সারাক্ষণ রাগারাগি করতেন কিন্তু বাবা চুপ থাকতেন। এই বকা আমাদের কাছে খারাপ লাগতো, বাবাকে বলতাম, আপনি কিছু বলেন? উনি বলতে চুপ থাকার অনেক সুবিধা আছে, এখন বুঝবে না।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় প্রথম চাচার বাসায় গিয়েছিলাম। তখন তিনি মতিঝিল কলোনীতে ছোট্ট একটি ফ্লাটে থাকতেন। সাগর লোহানী তখন অনেক ছোট, বন্যা লো-হানী আর ঊর্মি লো-হানী তো সাগর থেকেও ছোট। সেখানে চাচা ছাড়া চাচির মাও থাকতেন আবার বাইরের কিছু ঘনিষ্ঠ লোক যেমন একজন ছিলেন জাকির ভাই। যিনি পরে আমাদের সাথেও অনেক দিন থেকে ছিলেন, তিনি তখন উনাদের সাথে থাকতেন।
বাবার ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে, দেখেছি দুনিয়ার লোকজন আমাদের বাসায় এসে থাকতো। কত জায়গা থেকে তার হিসাব ছিল না। আমার বাবার এইসব নিয়ে কনো চিন্তা ভাবনা ছিল না-- কী খাবে, কোথায় ঘুমাবে, এইসব ঝামেলা মাকেই সমাধান করতে হতো। মা সারাক্ষণ রাগারাগি করতেন কিন্তু বাবা চুপ থাকতেন। এই বকা আমাদের কাছে খারাপ লাগতো, বাবাকে বলতাম, আপনি কিছু বলেন? উনি বলতে চুপ থাকার অনেক সুবিধা আছে, এখন বুঝবে না।
১৯৭৫ সালের শেষের দিকে, মশিউর রহমান জাদু মিয়া, যিনি বড় চাচার বন্ধু ছিলেন এবং বাবাকে নাম ধরে ডাকতেন। তিনি হুকুম দিলেন উনার দাওয়াত করা হোক। তাই একটি বড় দাওয়াতের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সময়ের অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিরা ওই দাওয়াতে এসেছিলেন। যাদের নাম মনে পড়ছে, এনায়েতুল্লাহ খান, সাপ্তাহিক হলিডের সম্পাদক, নির্মল সেন, কামাল লোহানী চাচা, হাসান সাঈদ, হায়দার আকবার খান রনো, আনওয়ার জাহিদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী আরো অনেকে। মা সারারাত বসে দুই'শ মুরগীর মোরগ পোলাও রান্না করলেন আর বাবাকে বকা দিতে থাকলেন। যা হোক ওই দাওয়াতটা বেশ জমজমাট হয়ে ছিল।
চাচা জীবনে অনেক চাকরি করেছেন আর ছেড়েছেন। মনের মতো কিছু না হলে ছেড়ে দিতেন। একমাত্র শিল্পকলা একাডেমির চাকরির মেয়াদ সম্পন্ন করতে দেখেছি। চাচার মানবিক গুনাবলি বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৭২ সালে কবি আহমেদ ইলিয়াস চাচার ছেলে আকিল গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তাররা তাঁকে কলকাতা নিয়ে যেতে বললেন। তখন ইলিয়াস চাচার আর্থিক অবস্থা এমন ছিল না যে ছেলের চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে কলকাতা যেতে পারতেন। লোহানী চাচা এই খবর জানার পর প্রেসক্লাবে রীতিমত চাঁদা তুলে ওই টাকাটা যোগার করলেন এবং চাচাকে দিলেন। সঙ্গে কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর সে সময়ের চিকিৎসককে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন যেন এর সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয়।
বাবা মারা যাবার পর চাচা আমার আরও কাছের হয়ে গেলেন এবং প্রায় ফোন করে আমার খোঁজ খবর নিতেন। মাঝে মাঝে দেখাও হতো। উনার সব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত থাকতাম যেখানে তিনি প্রধান বক্তা থাকতেন। অথবা যে অনুষ্ঠানগুলো উনাকে ঘিরে হতো। বাবার ওপর অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেছেন এমন কি উনার বই "যেন ভুলে না যাই", যেখানে উনি অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্বন্ধে লিখেছেন যেমন, বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী আরো অনেক, সেখানে উনি বাবাকে ভুলে যাননি তার ওপর একটি প্রবন্ধ ওই বইতে আছে। বাবার উর্দু কবিতার বাংলা অনুবাদের বই, "নওশাদ নূরীর নির্বাচিত কবিতা"র মুখবন্ধ উনার লেখা।
প্রায় ফোন করতেন, "তোমার কবিতা দেখলাম অমুক পত্রিকায়, বাবা তোমার গল্প দেখলাম, তুমি গল্পও লেখো আমি তো জানতাম না। তোমার বইগুলো আমাকে দিয়ে যেও"। আমিও বলতাম, হ্যাঁ চাচা একদিন নিয়ে আসবো। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো দিন বইগুলো দেয়া হলো না।
মনে আছে চাচার বোধহয় ৭০তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে জাদুঘরের আডিটোরিয়ামে। অনেক লোকজন। আমিও ছিলাম, ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলাম। চাচি খুব সুন্দর প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন চাচাকে নিয়ে। তারপর আবার ২০১৮ সালে আর একটি জন্মদিন পালন করা হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত, ওটাও বেশ একটি বড় আকারের অনুষ্ঠান ছিল।
জীবনের সব চেয়ে বড় দুঃখ যে উনি শেষবার হাসপাতালে ভর্তি হলেন কিন্তু আমি তাঁকে দেখতে যেতে পারিনি। আমি জানি বন্যা আর ঊর্মি তাঁকে আঁকড়ে রেখে ছিল, সাগর রাত আর দিন হাসপাতালের ডিউটি করেছে। তিনি চলে যাচ্ছেন আমরা টের পাচ্ছিলাম কিন্তু দেখতে যেতে পারিনি এমন কি তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতেও। এইভাবে করোনা আমাদের থেকে কত গুনীজনকে কেড়ে নিয়েছে।
Comments