‘ব্যক্তির বন্দনা সাহিত্যের অনেক ক্ষতি করেছে’

বাংলা একাডেমির আয়োজনে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন নতুন বই। এবারের মেলায় কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিনের 'পাঠের পরাগায়ন'। গণঅভ্যুত্থান, নিজের লেখালেখি ও বইমেলা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

অধিকাংশ মানুষ অনুবাদকে মৌলিক কাজ বলে না। অথচ এর মাঝে মেধা পরিশ্রম চিন্তা সবই আছে। কেন তাহলে এমন বলে? 

অনুবাদ সম্পর্কে যাদের গভীর কোনো ধারণা নেই তারা এমনটা বলে থাকেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, এমনকি প্রবন্ধকেও মৌলিক বলার মধ্যে যে ঝুঁকি আছে, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন বলে মনে হয় না। ঝুঁকিটা এই যে আমরা যে কাজগুলোকে মৌলিক কাজ বলে দাবি করি সেগুলোয় রয়েছে পূর্ববর্তী কোনো না কোনো রচনার প্রভাব। ফলে কোনো রচনাই শতভাগ মৌলিক নয়। আবার এও সত্য যে এই প্রভাব গ্রহণ করেই প্রতিটি রচনাকে মৌলিক হয়ে উঠতে হয়। অন্যদিকে, আমরা যে রচনাগুলো অনুবাদ হিসেবে জানি, সেগুলো লক্ষ ভাষার সংস্কৃতির স্পর্শে এসে  তা মূল ভাষার মতো আর থাকে না। যেটুকু থাকে না সেটুকু ওই অনুবাদের মৌলিক দিক। ফলে, অনুবাদ একই সঙ্গে মৌলিক ও অনুবাদ। আমরা অনুবাদ বা মৌলিক রচনার সঙ্গে এই সংযোগগুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলে এর চরিত্রগুলো আবিস্কার করতে পারি সহজেই।  

লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে আপনার দীর্ঘদিনের শ্রম। ওই সাহিত্যের নিজস্বতা ও আমাদের নেওয়ার মতো দিক কী?

লাতিন আমেরিকান সাহিত্য থেকে আমাদের নেয়ার মতো অনেক কিছুই আছে, আমরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতে নিচ্ছিও। যদিও প্রভাব গ্রহণের সক্ষমতাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। 'সাহিত্যে প্রভাব' সম্পর্কিত এক দীর্ঘ রচনায় আঁদ্রে জিদ এই বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন। গ্যোটে তার পূর্ববর্তী লেখক হার্ডার প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে "হার্ডার আমায় যা শিখিয়েছেন তার সবই আমি অনায়াসে আত্মস্থ করেছি।'' অর্থাৎ এই আত্মস্থ করার অনায়াস শক্তিটাও থাকতে হয়। আমাদের বেশিরভাগ লেখকদের সেই শক্তির অভাব আছে বলে আমার মনে হয়। অন্যদিকে, সাহিত্য সবসময়ই দেয়া-নেয়ার এক জটিল জালের মতো বন্ধনে জড়িয়ে আছে। এমন কোনো সাহিত্য নেই যা অপরের কাছ থেকে না নিয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু নিতে গিয়ে সে নিজস্বতা হারায় না, বরং নিজস্বতা তৈরি হয়। ওদের কাছ থেকে নেয়ার আছে ওদের কলাকৌশল, দেখার এক পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি, আর জনগোষ্ঠীর মন  ও তার সংস্কৃতির অদৃশ্য মাত্রাগুলোকে আবিস্কারের সৃজনীশক্তি।

'পাঠের পরাগায়নে' বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপের একধরনের সমন্বিত রূপ। এর পরিকল্পনা কতদিনের? 

পাঠের পরাগায়ন-এ বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তার প্রভাব নিশ্চয়ই আছে, সঙ্গে আছে ওদের সাহিত্যকে বুঝবার আবেগও। আবেগ যেমন ওদের সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসাকে চালিত করেছে, তেমনি সেই ভালোবাসাকে বিশ্লেষণ করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তার প্রয়োজন হয়েছে। এই অর্থে এটির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় তো আছেই। সমন্বয় আরও একটি ক্ষেত্রে। অমি সবসময়ই শুধুই ওদের সাহিত্য নিয়ে এমন কোনো প্রবন্ধ লিখতে চাইনি যা ওদের সম্পর্কে ইতোমধ্যেই সাহিত্যসমালোচনামূলক গ্রন্থ বা প্রবন্ধে সহজলভ্য। আমাদের  ভাষা ও সাহিত্যের জন্য প্রাসঙ্গিকতার বিবেচনাটা আমার মাথায় থাকে, সেটা থাকে বলেই এক সমন্বয়ের ভাবনা কাজ করে এবং সেইভাবে আমার চিন্তাগুলো সাজাই। কত দিনের পরিকল্পনা? সত্যি বলতে কি খুব যে পরিকল্পনা করে এই লেখাগুলো লিখিত হয়েছে, তা নয়। আপনি বোধহয় জানেন যে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের প্রতি আমার একটা পক্ষপাত রয়েছে। নানা সময়ে, বিশেষ করে গত পনের বছরে এই অঞ্চলের সাহিত্য নিয়ে আমি যেসব প্রবন্ধ লিখেছি, সেখান থেকে নির্বাচিতগুলো নিয়ে এই প্রবন্ধের বই। 

আমাদের সাহিত্য সমালোচনার তুলনায় ব্যক্তির বন্দনা বেশি। উত্তরণের উপায় কী?

ব্যক্তির এই বন্দনা আমাদের সাহিত্যের অনেক ক্ষতি করেছে। গৌণকে মূখ্য করে তুলেছে, আর মূখ্য যারা তাদেরকে আড়াল করে রেখেছে। এইভাবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। উত্তরণের উপায় সাহিত্যের প্রতি সৎ হওয়া, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা। ব্যক্তির বন্দনা তখনই ভালো হতে পারে যদি তা সত্যিকারের গুণী ব্যক্তির বন্দনা হয়। 

কবিতার পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যের ভাষা ও চিন্তা নিয়ে কাজ করেন। আমাদের সাহিত্য কতটা এগিয়েছে? 
আমাদের প্রয়াত প্রবীণরা সৃজনে ও মননে যতটা এগিয়েছিলেন, আমরা সেই তুলনায় মনে হয় না ততটা এগুতে পেরেছি। আমাদের জীবিত লেখকদের মধ্যে এগিয়ে থাকার জন্য যতটা মেধা মনন ও অঙ্গীকার দরকার ছিল, আমাদের মধ্যে তার অনেক অভাব অনুভব করি। আমি নিজেও সেই অযোগ্যদের একজন। অগ্রগতি যদি কিছু হয়েও থাকে, সমালোচনা সাহিত্যের দারিদ্রের কারণে সেটা চিহ্নিত করার অভাবটাও প্রকট। 

অনুবাদ এখন অনেকে করে। মান ও ভাষা নিয়ে বেশ গড়মিল দেখা যায়। অন্যদিকে অনুমতি নেয়ার বালাই নেই। এটা কী ধরনের সংস্কৃতি?
মান ও ভাষা নিয়ে ঝামেলার কথা বহুবার বলেছি। সুতরাং নতুন করে বলার আর কিছু নেই। অনুমতি নেয়ার কথাও বলতে গিয়ে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। নতুন করে কী আর বলবো। জানি, অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে অনেক বাধা আছে, অনুমতি নিতে গিয়ে সেই বাধার কথা কেউ কেউ বলেছেনও। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ অনুবাদকই অনুমতি পাওয়ার কোনো তোয়াক্কা করেন না। এই সংস্কৃতির বদল হওয়া উচিত। 
 

Comments

The Daily Star  | English
AI-manipulated image of Shahbagh engineering students’ protest, DMP claims

Debunking DMP claim, frame by frame

The Daily Star photographer, who was present at the scene, described the incident as it unfolded

1h ago