চব্বিশের অভ্যুত্থানে দেশভাগের প্রসঙ্গ

জেন-জি দ্বারা পৃথিবীর প্রথম অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় বাংলাদেশে, ২০২৪ সালে। এই প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়া ও 'বাংলাদেশ রাজনীতি' প্রশ্নে জেন-জি কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে, তার ওপর অনেকটাই নির্ধারণ করছিল জুলাই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। এবং ফলাফল হিসেবে যা ঘটেছে, তার পেছনে রয়েছে সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও আওয়ামী লীগের ধর্মীয় 'বাইনারি ন্যারেটিভ' ভেঙে চুরমার করার ইতিহাস।
চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়া, রাজনৈতিক চেতনা ও ধর্মীয় ইস্যু সামনে ছিল, তেমনি অদ্ভুতভাবে সাতচল্লিশের দেশভাগের সামনেও ছিল একই ধরনের বিষয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সমর্থন দেওয়া মানুষেরা জুলাইয়ে স্বয়ং আওয়ামী লীগ দ্বারাই ভয়াবহ দমন নিপীড়নকে কীভাবে 'ডিল' করবেন, সেই প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। দেশভাগের ক্ষেত্রেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পূর্বের রাজনীতির সঙ্গে ভারতের নির্মাণকে ঠিক কীভাবে গ্রহণ করা হবে তা নিয়েও এক রকম মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। দেশভাগের হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি তো ছিলই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এই সময়ের সেক্যুলারিজম ও রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতাকে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া। সব মিলিয়ে সাতচল্লিশের দেশভাগের রাজনৈতিক জটিলতাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চব্বিশের অভ্যুত্থানকে বিশ্লেষণ করলে, জুলাই অভ্যুত্থান পাঠে নতুন দিক উন্মোচিত হবে বলে বোধ করি।
আবুল মনসুর আহমদের লেখায় দেশভাগের পর হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের একটা চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম একজন ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পরেও তিনি ভারত থেকে চলে আসেননি; বরং সেখানে ওকালতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি লিখেছেন, 'এ অবস্থায় পাকিস্তান হাসিলের পর আমাকে অলীপুরে ওকালতি করিতে দেখিয়া তাঁরা অনেকেই নিশ্চয়ই বিস্মিত হইয়াছিলেন। কেউ-কেউ নিশ্চয়ই চটিয়াও গিয়াছিলেন। তা সত্ত্বেও বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নাই। তাঁরা আগের মতই হাসিমুখে একদিন বলিলেন: "এখনও এখানে আছ যে? পাকিস্তান চেয়েছিলে, পাকিস্তান পেয়েছ। তবে আর এখানে বসে আছ কেন?" আমিও বরাবরের মত হাসিমুখে বলিলাম: "তোমরা হিন্দুরা বড় চালাক। আমিন বাধ্য কৈরা বাঁটোয়ারার ছাহামে আমাদেরে ঠকাইছ। বাংগালরে তোমরা হাইকোর্ট দেখাইছ। ফলে আমাদের ভাগে জমি কম পড়ছে। কাজেই আরো কিছু জমি খসাবার মতলবে আমরা জনকতক এখানে কিছুদিন থাকব ঠিক করছি"। সকলে হো-হো করিয়ে উচ্চস্বরে হাসিয়া উঠিলেন।'
যদিও আবুল মনসুর আহমদ দেশভাগের সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন না। তবে ঠিক সেসময়ই হিন্দুদের সঙ্গে 'মুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট' হিসেবে তার এই ধরনের কথোপকথন আমাদেরকে হিন্দু-মুসলিম সামাজিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত করে। কারণ প্রচলিত হয়ে আসা বয়ানে, 'ধর্মের ভিত্তিতে' দেশভাগ হওয়াকেই বিশ্বাস করে এসেছি। এবং সেই বিশ্বাসে সবসময়ই মুসলিমদেরকে দায়ী করা হয়েছে। যেন বা মুসলিমরা পাকিস্তানের মতো 'ধর্মীয় রাষ্ট্র' না চাইলে, কোনোদিন হিন্দু-মুসলিম প্রশ্ন আসতো না এবং ভারতও ভাগ হতো না। এই কথা আংশিক সত্য বটে। তবে তারা এই কথা আর বলে না যে, পাকিস্তান আন্দোলন না হলে ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের ১৮০ বছরের শাসনের অবসানও ঘটতো না।
উপনিবেশিক শাসনকে জারি রাখতে হিন্দু ব্রাহ্মণদেরকে যেভাবে হাত করতে পেরেছিল ইংরেজরা, স্বাভাবিকভাবেই এই শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মুসলিমদের পশ্চাৎপদ বিষয়টিও মুখ্য হয়ে উঠেছিল। পিছিয়ে পড়া মুসলিমরা বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন থেকেই পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। খেয়াল রাখতে হবে, মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা সেসময় পাকিস্তান আন্দোলনকে মুসলিমদের অগ্রসর হওয়ার একটি স্বপ্ন হিসেবে দেখলেও, কখনই এই আন্দোলনকে 'হিন্দু বিরোধী' আন্দোলন হিসেবে সামনে আনেন নাই। সেসময়কার মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের এই দূরদর্শী চিন্তা আমাদেরকে এখনো মুগ্ধ করে।
যদিও দেশভাগের ইতিহাস পড়ার ক্ষেত্রে মুসলিমদের প্রচলিত দৃশ্যায়নে চিড় ধরিয়েছেন ভারতীয় লেখক জয়া চ্যাটার্জী। তার বহুল সমালোচিত 'বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কমিউনালিজম অ্যান্ড পার্টিশন ১৯৩২-১৯৪৭' বইতে তিনি দেশভাগের প্রেক্ষাপটে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার এক গুরুত্বপূর্ণ বয়ানকে সামনে এনেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, শতাব্দীর শুরু থেকেই হিন্দুদের মাঝে জাতি বিভেদ দৃঢ় হচ্ছিল। এতে করে আদম শুমারির সময়ে নিম্ন জাতের হিন্দুরা নিজেদেরকে উচ্চবর্গের দেখানোর প্রচেষ্টা চালানো শুরু করে। এতে করে উঁচু জাতের হিন্দুদের দুই ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। প্রথমত, নিজেদের ব্রাহ্মণবাদ টিকিয়ে রাখতে 'নিম্ন শ্রেণির হিন্দু' বলে একটি বড়সড় জনবল থাকার প্রয়োজন ছিল, যেটি তাদেরকে ক্ষমতার পার্থক্য তুলে ধরতে সাহায্য করবে। আর দ্বিতীয়ত, মুসলিমদের অধিকার আন্দোলনের বিপরীতে হিন্দুদের ঐক্য ধরে রাখতেও জটিলতায় পড়তে হচ্ছিল। অর্থাৎ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা হিন্দুরা একইসঙ্গে সব হিন্দুকে একত্রে রাখতে চাচ্ছিলেন আবার একইসঙ্গে তারা সব হিন্দুকে সমান অধিকার দিতে অনাগ্রহী।
জয়া চ্যাটার্জীর বইতে উল্লেখ আছে, শতাব্দীর শুরু থেকেই হিন্দু রাজনৈতিক ঐক্যের মতাদর্শীরা অস্পৃশ্যদের উন্নয়ন এবং শ্রেণি বিভেদের বাধা দূর করার কর্মসূচি সমর্থন করে। স্বামী বিবেকানন্দ 'সত্য যুগে'র আগমন প্রত্যাশা করেন যখন 'একটি শ্রেণি (ব্রাহ্মণ) থাকবে, একটা বেদ থাকবে, আর থাকবে শান্তি ও সংহতি'। কিন্তু ঐক্যের বিষয়টি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একটা সুদূর পরাহত স্বপ্ন হিসেবেই থাকে। ১৯২৬ সালে তার লেখা প্রবন্ধ 'বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা'য় তিনি বলেন, হিন্দুদের সামনে সবচেয়ে বড় কঠিন কাজ হলো 'নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য অর্জন করা' এবং এ ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানো 'যা দীর্ঘ দিন ধরে হিন্দু ধর্মকে বিকৃত করেছে—ছোট জাতি বলে কিছু লোককে অপমান করেছে'।
ভারতের অন্যান্য কিছু অংশের মতো বর্ণের ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ বাঙলায় ততটা কঠোর না হলেও উচ্চ শ্রেণির বাঙালি হিন্দুরা তাদের মতোই সংস্কার মেনে চলত। বর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কারদের আন্দোলনের সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৯৩৩ সালের আনটাচেবিলিটি বিল নিয়ে এবং ১৯৩৪ সালের 'ডিপ্রেসড ক্লাসেস স্ট্যাটাস বিলের' বিরুদ্ধে বাঙলা যে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেই প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পারে যে, মোটামুটিভাবে ভদ্রলোক-বাঙলা বর্ণভেদের ব্যাপারে যথেষ্ট গোঁড়া ছিল।
আওয়ামী আমলে ক্ষমতা পুঞ্জিভূত করতে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবকে প্রশ্নের মুখে রেখে আওয়ামী লীগ সরকার 'যেমন খুশি তেমন সাজো'তে বেছে নিত 'সেক্যুলার' সাজ। আওয়ামী প্রবর্তিত সেক্যুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা অনুযায়ী জনগণকে বেছে নিতে হতো, হয় সেক্যুলার নয় জঙ্গি। আবার সেই সেক্যুলার ধারণাও আওয়ামী প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী হতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই ১৬ বছরে ইসলামপ্রশ্নে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অনেক বেশি একপেশে হয়ে উঠেছিল।
আগেই বলেছি, এই প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়া ও ইসলামপ্রশ্নে বাংলাদেশি জেন-জি কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে, তার ওপর অনেকটাই নির্ধারণ করছিল জুলাই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে হাত ধরে হালের পশ্চিমা পোশাকের একজন শিক্ষার্থীর আন্দোলনে অংশ নেওয়ার একটি ছবি সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফলত একটি ছবিই আওয়ামী প্রবর্তিত ধর্মীয় মেরুকরণ প্রকল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
পরবর্তীতে যখন আওয়ামী সরকার শিক্ষার্থীদের ওপর শক্তিপ্রয়োগ শুরু করে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন শহীদ হন মাদারীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী দীপ্ত দে। ৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রোহ যাত্রা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। সেসময় একজন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দীপ্ত দের ছবি হাতে নিয়ে উপস্থিত হন, ছবিতে লেখা ছিল 'শহীদ দীপ্ত দে, আমরা তোমাদের ভুলব না'। জুব্বা ও টুপি পরিহিত একজন শিক্ষার্থীর হাতে শহীদ দীপ্তর ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, সেই ছেলেটির পায়ের কাছেই ভেঙে পড়েছিল আওয়ামীদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের তাসের ঘর।
তাই দেশভাগকে সামনে রেখে জুলাই অভ্যুত্থানকে পাঠ করতে গেলে, এটিকে নেহায়েতই রাজপথের আন্দোলন বলে মনে হয় না। বরং যুগ ধরে চলা সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ইসলাম-প্রশ্নে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় মূলধারা থেকে দূরীকরণের প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমাদের ছাত্র-জনতার যুদ্ধ ঘোষণা এই আন্দোলনের গতিপথকে অনেকখানি নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
মোহাম্মদ আজম জুলাই অভ্যুত্থানের নিরিখে এই বিষয়ক একটি আলাপ সামনে এনেছেন। 'ইসলামপ্রশ্ন' ও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার 'মূলধারা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ তিনি পাঠ করেন ১৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ইসলামি উপাদানকে মূলধারায় থেকে দূরে রাখার বিভিন্ন ক্ষতিকে সামনে আনেন।
তিনি বলছেন, আমাদের বিবেচনায়, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের বিপুল তরুণ সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে। 'ইসলামি' জ্ঞান ও বোঝাপড়ার একটি মাত্রা সাংস্কৃতিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রাক্কালেই অন্তত মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েরা অর্জন করে। এটা তার বিশ্বদৃষ্টির অঙ্গীভূত হয়। বড় হয়ে যখন সে 'সেক্যুলার' পড়াশোনায় অংশ নেয়, তখন বিরোধমূলক ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে তাকে হয় পুরো ব্যাপারটা ভুলে যেতে হয়, কিংবা এমনভাবে চাপা রাখতে হয়, যেন কোনো মিলমিশ না ঘটে। যাপিত জীবনের অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানমূলক কাজে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা এর ফলে বেশ পরিমাণে বিনষ্ট হয়। কোনো সন্দেহ নাই, এ পরিস্থিতি যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
জুলাই আন্দোলনকে পাঠ করার ক্ষেত্রে এই বয়ান চিন্তার জন্ম দেয়। তবে মোহাম্মদ আজমের বিশ্লেষণে আরও একটি চমকপ্রদ বিষয় উঠে আসে যে, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আসা ধর্মীয় মেরুকরণের কালো হাতগুলোকে আন্দোলনকারীরা বিশেষ করে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। একারণেই আন্দোলনে 'বৈষম্যবিরোধী' শব্দ দিয়ে তারা যেই রাজনৈতিক ইশতেহার দিয়েছিলেন, সেখানে দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তারা ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার এই আন্দোলনকে 'সেক্যুলার-বিরোধী' আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে আন্দোলনকারীরা পূর্ব প্রস্তুত ছিলেন। যা মূলত শেখ হাসিনার ধর্মীয় রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল।
আজম বলছেন, আন্দোলন চলাকালীন পুরো ব্যাপারটিকে 'ইসলামি' ভেনচার হিসেবে প্রচার করেছিল সরকার, অনুগত মিডিয়া এবং সংশ্লিষ্ট মত-উৎপাদনকারীরা। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ আগেই 'শাহবাগ-শাপলা' নামের রাষ্ট্র-প্রযোজিত বাইনারির মধ্য দিয়ে গেছে। ২০১৩-পরবর্তী নতুন ভাব-ভাষা উৎপাদনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। 'ইসলামফোব' বুদ্ধিজীবিতার বিপরীতে গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার ভাষা খানিকটা হলেও রপ্ত করেছে। কাজেই এ আন্দোলনকালীন রাষ্ট্রীয় প্রচারণার ব্যাপারে সতর্ক থাকার মতো ভাষার জোর তার তহবিলে ছিল।
তিনি আরও বলছেন, বিরোধমূলক সাংস্কৃতিক নির্মাণ এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সে বিভেদের ওপর দাঁড় করানোই যেহেতু গত রেজিমের প্রধান ভাবাদর্শিক অ্যাপারেটাস ছিল, তার বিরুদ্ধে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান স্বভাবতই সেই বিরোধমূলক দ্বিবিভাজনের বিপরীতেই নিজের ভাষারূপ দাঁড় করিয়েছে। এটা সচেতনভাবেও হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেও হয়েছে। আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গের জন্য সবচেয়ে জরুরি কথা হলো, এভাবে আমাদের গত অন্তত ৭০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এরকম এক মুহূর্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছে, যখন ইসলামচর্চাকারীরা 'মূলধারা'র যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ করার জন্য উপযোগী ভাষা তথা পাটাতন নাগালে পেয়েছে।
আপাত আলোচনায় দেশভাগের ধর্মীয় রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে জুলাই অভ্যুত্থান পাঠে মোহাম্মদ আজমের চিন্তা অনেকটাই উপসংহারের পথে নিয়ে যায়। তবে একাত্তরের যে ঘোষণাপত্রের ওপর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, বাহাত্তরে সংবিধান লেখার সময় একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলনীতি উপেক্ষিত হয়েছিল। তাই জুলাই অভ্যুত্থান পাঠের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে এর সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার জায়গা যেন উপেক্ষিত না হয়, সেদিকে আমাদের পর্যবেক্ষণ জারি রাখতে হবে।
Comments