অনুভবের যৎসামান্য- ২০

কখন আমাদের অবাধ্যতা প্রয়োজন?

স্বাধীনতার ঘোষণায় যে নীতি, লক্ষ্য ও স্পিরিট আছে আমরা সেখানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এ স্পিরিট অবৈধ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। এই স্পিরিট সেই শক্তির বিরুদ্ধে যা মানুষদের তাদের জীবন, স্বাধীনতা, ও সুখ খোঁজার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

যদি বলি, যতদিন আপনি নিজের জীবনটি কাঙ্ক্ষিতভাবে যাপন করতে না পারছেন ততদিন বুঝবেন, আপনার রাষ্ট্র সঠিক অবস্থায় নেই, তাহলে আপনি ভাবতেও পারেন যে, কাঙ্ক্ষিত জীবন যাপন করার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী? কিংবা প্রশ্ন করতে পারেন, কাঙ্ক্ষিত জীবন বলতে কী বোঝায়? যা ইচ্ছে তাই করা? হ্যাঁ, এক অর্থে তাই। তবে এই ইচ্ছেটা ততদূর পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য যতক্ষণ অন্যের জীবন তাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হচ্ছে।

কিংবা ধরুন, যদি বলি, যে আইন ন্যায়সঙ্গত নয়, তা মানার বাধ্যবাধকতা আপনার নেই, তাহলেও আপনার মনে হতে পারে, আইন না মেনে কীভাবে সুনাগরিক হওয়া সম্ভব? তাছাড়া, কোনটা ন্যায়সঙ্গত আইন আর কোনটা নয়, তা বুঝবো কী করে? বুঝতে হবে আপনার বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে।

ধরা যাক, রাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপের কারণে কোনো অপরাধ না করেও আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে, কিন্তু আপনি তার প্রতিবাদ করতে পারছেন না, এমনকি কথাও বলতে পারছেন না, কারণ রাষ্ট্র আইন করে আপনার কথা বলার স্বাধীনতাও কেড়ে নিয়েছে, তাহলে সেই পদক্ষেপ এবং সেই আইন অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত নয়, এবং আপনি তা মানতে বাধ্য নন। 

রাষ্ট্র আপনার জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছে আবার কথা বলার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে, এ তো হতে পারে না। আপনি যদি বিনাপ্রশ্নে এসব অন্যায় পদক্ষেপ এবং আইন মেনে নেন, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি আর মানুষ নন এবং আপনার মানবিক মর্যাদা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই, আপনি একটা যন্ত্র বা জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। রাষ্ট্র এবং আইনের প্রতি এই প্রশ্নহীন মান্যতা আপনার মানবিক অস্তিত্বকে এভাবেই বিপন্ন করে তোলে।

এই প্রশ্নগুলো নতুন নয়। ১৮৫৪ সালে আমেরিকান দার্শনিক-প্রকৃতিবিদ হেনরি ডেভিড থরো তার Civil Disobedience শিরোনামের প্রবন্ধে এইসব প্রশ্ন তুলেছিলেন। থরোর প্রবন্ধটিকে বলা হয় মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রবন্ধের অন্যতম। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন মেন্ডেলার মতো মহান নেতারা তাঁদের চিন্তা এবং কর্মপদ্ধতির ওপর থরোর সরাসরি প্রভাবের কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এবং ১৯৭১-এর মার্চের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল, সেটিতেও থরোর চিন্তার প্রভাব দৃশ্যমান ছিল।  

থরো বলেছিলেন : 'ন্যায়সঙ্গত নয় এমন অনেক আইন আছে। আমরা কি সানন্দে এগুলোকে মেনে নেব? নাকি এগুলো শোধরানোর চেষ্টা করব? যতক্ষণ-না শোধরাতে পারছি আমরা ঐ অন্যায় আইনকে মান্য করে যাব? নাকি কোনও আইনকে অন্যায় মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে তা অমান্য করব? এ-ধরনের সরকারের অধীনে মানুষরা মনে করে, যতদিন-না সরকার পাল্টানোর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত পাওয়া যাচ্ছে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে। তারা মনে করে যে তার আগেই যদি তারা সরকারকে বাধা দেয় তাহলে হিতে বিপরীত হবে। কিন্তু যদি সত্যিই হিতে বিপরীত হয় তাহলে দোষটা তাদের হবে না, দোষটা হবে সরকারের।

এক্ষেত্রে সরকারই পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়।... যদি সহায়-সম্বলহীন একজন মানুষ সরকারের নয় শিলিং তছরুপ করে তাহলে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে ঢোকানো হয় কিন্তু কেউ যদি নয় শিলিং-এর ৯০ গুণ বেশি চুরি করে তাহলে তার কিছু হয় না; সে দিব্যি জেলের বাইরে ঘুরে বেড়ায়। এ-ধরনের অবিচার যদি রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হয় তাহলে অসুবিধা নেই, কারণ সেই ত্রুটি হয়তো দূর করা যাবে। কিন্তু যদি দেখেন রাষ্ট্র আপনাকে তার এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে অন্য কারও ওপর অবিচার করছে, তাহলে আমি বলব যে-আইনের বলে রাষ্ট্র এই কাজটা করছে সেই আইনটা ভেঙে ফেলুন। আপনার জীবনটা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীত দিকে ঘুরে ঐ যন্ত্রটা বন্ধ করে দিক।' 

হেনরি ডেভিড থরো নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না। সব আইনই অমান্য করতে হবে কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে হবে তা তিনি মনে করতেন না। তবে, যেসব আইন অপরের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে এবং যেগুলোকে তিনি ন্যায়সঙ্গত আইন বলে মনে করতেন না, সেগুলো মানতে নারাজ ছিলেন। কেবল এসব বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি নিজেই আইন অমান্য করে কারাগারে গিয়েছিলেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের জন্য নানারকম কর আরোপ করা হতো। তিনি ভাবলেন, যদি তিনি আইন মেনে কর দেন তাহলে সরকার সেই করের টাকায় দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখবে এবং মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে তার রসদ জোগাবে। তিনি দাসপ্রথা এবং যুদ্ধের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন বলে কর দেয়া থেকে বিরত রইলেন এবং গ্রেফতার বরণ করে কারাগারে গেলেন। যদিও তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী আত্মীয় সেই বকেয়া কর পরিশোধ করে তাঁকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা তাঁর মোটেই পছন্দ হয়নি। বরং কারাগারে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, সঠিক মানুষগুলোই কারাগারে আছে, আর যাদের কারাগারে থাকার কথা তারা আছে বাইরে, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে।

থরোর জীবনটা ছিল অদ্ভুত ধরনের। হাভার্ড গ্র্যাজুয়েট ছিলেন তিনি, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন এক প্রাকৃতিক জীবন। ম্যাসাচুসেটসের কনকর্ডের কাছে 'ওয়ালডেন পণ্ড' নামক বাড়িতে 'সামাজিক নিরীক্ষার অংশ হিসেবে' থাকতে গিয়েছিলেন তিনি। কেন? কারণ 'মাত্রাতিরিক্ত সভ্যতা থেকে বাঁচার জন্য' এবং 'অকৃত্রিম ও বুনো আনন্দ' উপভোগ করার জন্য অরণ্য-সংলগ্ন ওই বাড়িটি তাঁর কাছে অত্যন্ত উপযুক্ত মনে হয়েছিল।

যাহোক, তাঁর সেই বিখ্যাত প্রবন্ধটি তিনি শুরু করেছিলেন এভাবে : 'আমি মনেপ্রাণে যে নীতিতে বিশ্বাস করি সেটা হচ্ছে, 'সেই সরকারই সবচেয়ে ভালো যেটা সবচেয়ে কম শাসন করে'; এবং আমি দেখতে চাই এটা যেন এভাবে আরও দ্রুত ও আরও শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করে এমন একটা পর্যায়ে যায় যাতে সবাই বলে- 'সেই সরকারই সবচেয়ে ভালো যেটা একেবারেই শাসন করে না।'

একনায়কতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী কোনো সরকার দূরে থাক, এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারও যে সবসময় সঠিক কাজ করে না, তিনি সেটি মনে করিয়ে দেন এবং এক্ষেত্রে নাগরিকদের দায়িত্বকেও স্মরণ করিয়ে দেন সেই লেখার মাধ্যমে। সমর্থন করা মানে যে নিজের বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা বন্ধক দেওয়া নয়, সেটিও বলেন : 'সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সবক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে না। এমন সরকার কি হতে পারে না যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নয়, বিবেকের বিবেচনাতেই ঠিক হবে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক? এক মুহূর্তের জন্য হলেও নাগরিকদের বিবেক কি আইনপ্রণেতাদের কাছে সমর্পণ করা উচিত? তাহলে যে সবার বিবেক বলে একটা বিষয় আছে তা আর থাকার দরকার কী! আমার মনে হয় আমরা আগে মানুষ তারপর প্রজা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার চাইতে বেশি হওয়া উচিত নয়। আমি কেবল সেই কাজ করতে বাধ্য যা আমার কাছে সর্বদাই সঠিক বলে প্রতীয়মান হবে।'

থরো আইনের প্রতি মানুষের অতিভক্তিকে ক্ষতিকর বলে মনে করেন, তীব্রস্বরে এইসব মানুষের মনুষ্যসত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন-- এরা কি মানুষ? -- 'আইন মানুষকে কখনও কণা-পরিমাণও ন্যায়বান করে না। বরং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে গিয়ে ভালো মানুষরাও অন্যায় কাজ করে ফেলে, এমনকি ন্যায়বিচারহীনতার এজেন্টে পরিণত হয়। ... তারা খুব ভালো করেই জানে যে, তারা যে-কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা একটা জঘন্য কাজ। তারপরও তারা বিনা প্রতিবাদে নীরবে এই কাজটা করতে যাচ্ছে। এরা কারা? এরা কি আসলে মানুষ? নাকি তারা কোনও বিবেকবর্জিত ক্ষমতাবান মানুষের সেবায় নিয়োজিত চলমান দুর্গ বা গোলাবারুদ?'

সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজের মানবিক-পরিচয় এবং মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করতেন না তিনি, বরং মনে করতেন তাঁর 'দেশের যত অর্জন হয়েছে তা জনগণের জন্যেই হয়েছে। সরকারি বাধা না পেলে এই অর্জনটা বরং আরও বেশি হতো। মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারাটাই যেন সরকারের সাফল্য। যে দেশের মানুষ যত একা, সেই দেশের সরকার তত সফল।'

মানুষের করণীয় সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা ছিল এরকম : 'অন্যায়কে শুধরে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্র আমার জন্য কোনও উপায় রেখেছে কি-না আমার জানা নেই বা রাখলেও সেই পথ এত লম্বা যে, সেই পথ হেঁটে পেরোতে গেলে জীবনটাই ফুরিয়ে যাবে। আমার তো আরও কাজ আছে। আমি তো পৃথিবীকে আরও বেশি বাসযোগ্য করার জন্য এই জগতে আসিনি, ভালো হোক কি মন্দ আমি তো এখানে আমার জীবন যাপন করতে এসেছি। একজন মানুষকে যে সবকিছু করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সে হয়তো অল্প কাজই করবে।

তবে এটা দেখা উচিত যে, ঐ কাজটুকু যেন সে ঠিকভাবে করে। তার সব কাজ করার সুযোগ নেই বলে, বা তার কেবল সামান্য কিছু কাজ করার সুযোগ আছে বলে সে যেন সেগুলো যেনতেনভাবে না করে। আমার যেমন সরকার বা আইনসভার কাছে আবেদন জানানো উচিত, তাদেরও তেমনি আমার কাছে আবেদন করা উচিত। তারা যদি আমার আবেদনে সাড়া না দেয়, আমি কেন ওদের কথা শুনব? কিন্তু এক্ষেত্রে রাষ্ট্র আমার জন্য কোনও উপায় খোলা রাখেনি। এর সংবিধানটাই যত নষ্টের গোঁড়া। এই কথাটা কর্কশ, অনমনীয়, ও শত্রুভাবাপন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু ভালো কিছু পাওয়ার জন্য এভাবে সরাসরি বলাটাই উত্তম। ভালো কিছু পেতে হলে এরকম কর্কশ ও কঠিন কিছুর মুখোমুখি হয়ে কষ্ট হজম করতে হয়; জন্ম ও মৃত্যুর সময় যেমন কষ্ট হয়, ঠিক তেমন কষ্টই সহ্য করতে হয়।'

আগেই বলেছি, থরোর এই প্রবন্ধটি দীর্ঘকাল ধরে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রবন্ধ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। আইন অমান্য আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি অহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচিরও উদ্ভব হয়েছে এই লেখার প্রভাব থেকে। তাঁর কথার রেশ ধরে ১৯৭০ সালে আমেরিকান ইতিহাসবিদ, দার্শনিক এবং নাট্যকার হাওয়ার্ড জিন একটি বক্তৃতা দেন  The Problem is Civil obedience শিরোনামে। নিঃসন্দেহে শিরোনামটি কৌতূহলোদ্দীপক। আমরা তো সাধারণত ভেবে থাকি আইনের প্রতি মানুষের অসম্মান এবং অবাধ্যতাই সকল সমস্যার মূল, সবাই আইন মেনে চললে কোনো সমস্যাই থাকতো না। অথচ তিনি অবাধ্যতাকে সমস্যা বলে ভাবছেন না, বলছেন নাগরিকদের বাধ্যতাই আসল সমস্যা। পুরো বক্তৃতায় তিনি এই চমকপ্রদ ব্যাখ্যা করেন।

তিনি বলেন :  'আমাদের প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে নাগরিক বাধ্যতা। আমাদের সমস্যা হচ্ছে সারা পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য মানুষ যারা তাদের সরকারের নেতাদের আদেশ মান্য করে এবং যুদ্ধে যায়, এবং এই আনুগত্যের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়।... আমাদের সমস্যা হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ খুব বাধ্য; দারিদ্র্য,ক্ষুধা, ও নির্বুদ্ধিতায় নিপীড়িত হতে যেমন বাধ্য তেমনি যুদ্ধ বা নৃশংস কাজ করতেও তারা বাধ্য। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমাদেরকে বাধ্য হয়েই জেলগুলোকে ছোটখাটো চোর ছ্যাঁচ্চড়ে ভর্তি করে রাখতে হয় এবং বড় বড় চোরদেরকে রাষ্ট্র-পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হয়।'

হাওয়ার্ড জিনের বক্তৃতাটিও পরবর্তীকালের রাজনৈতিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন এভাবে :  'এটা ধরে নিয়ে শুরু করা যাক যে এই পৃথিবী এখন খুব এলোমেলো অবস্থায় আছে, সবকিছুই ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে; ভুল মানুষরাই কারাগারের ভেতর আছে এবং ভুল মানুষরাই কারাগারের বাইরে আছে; ভুল মানুষরাই ক্ষমতায় আছে এবং ভুল মানুষরাই ক্ষমতার বাইরে আছে; এই দেশ এবং পুরো পৃথিবীতে সম্পদ এমনভাবে বণ্টন করা হয়েছে যে এক্ষেত্রে বড় ধরনের একটা সংস্কার প্রয়োজন।'

বুঝতেই পারছেন প্রিয় পাঠক, বক্তৃতার শুরুতেই তিনি এমনসব কথা বলেন যা আজও সমানভাবে প্রযোজ্য এবং প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে আমাদেরকে জাগিয়ে তোলে। এবং সবকিছুই যে ওলটপালট হয়ে গেছে, তার কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন নাগরিকদের অতিমাত্রায় বাধ্য হওয়ার বিষয়টিকে। সব আইনকেই কেন মান্য করতে হবে, বিশেষ করে সেইসব আইন যা আমাদের মানবিক মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। প্রশ্ন তোলেন আইনের কার্যকারিতা এবং আইনপ্রণেতাদের সম্বন্ধেও।

বলেন : 'আইন কোনও পবিত্র বিষয় নয়। আইন কে বানায় সেটা নিয়ে একটু ভাবুন। ঈশ্বর নন, আইন তৈরি করে স্টর্ম থারমন্ডের মতো মানুষ। আইনের কথা ভাবতে গিয়ে আপনার যদি পবিত্রতা, সৌন্দর্য, শ্রদ্ধা ইত্যাদি কথা মনে আসে তাহলে দেশের আইনপ্রণেতাদের দিকে একটু তাকান। স্টেটের আইনসভার সেশনগুলোতে- গিয়ে বসুন, কংগ্রেসে বসুন। এরাই হচ্ছে সেইসব মানুষ যারা আইন তৈরি করে এবং আমাদের সেই আইনগুলোকেই শ্রদ্ধা করার কথা।'

আমরা তো আইনের অধীনেই বাস করি, তবু কেন এত বিশৃঙ্খলা; নাগরিক অবাধ্যতা নাকি নৈরাজ্য তৈরি করতে পারে, তাহলে এত বাধ্য জনতা নিয়েও বিশ্বজুড়ে কেন এত নৈরাজ্য এইসব প্রশ্ন করে তিনি হতকচিত করে তোলেন। শুধু তাই নয়, সত্যিকারের কল্যাণ এবং শৃঙ্খলা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তিনি তাও বলেন -- 'বর্তমান দুনিয়ার দিকে একটু তাকান যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণভাবে আমরা যাকে নৈরাজ্য বলি, দেখুন, তার প্রায় সবই আছে সেখানে --  বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা, এবং দস্যুবৃত্তি। আইন প্রয়োগ করে সত্যিকারের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এটা এমন একটা সমাজের মধ্য দিয়ে আসে যেটা ন্যায়বান, যেখানে ঐকতানি- সম্পর্কগুলো তৈরি হয়, এবং যেখানে মানুষের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি কর জন্য ন্যূনতম বিধিবিধানের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আইনের ওপর বা আইনের প্রতি ওপর ভিত্তি করে যে শৃঙ্খলা সেটা টোটালিটারিয়ান স্টেটের শৃঙ্খলা। এবং এট অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে ন্যায়হীনতা বা বিদ্রোহ- অন্যকথায় এটা শেষ পর্যন্ত একটা ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যায়।'

তাঁর দেশ স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে সরে এসেছে এবং সেটি মূলত ন্যায়সঙ্গত নয় এমনসব আইন মেনে চলার জন্যই হয়েছে সেটি জানাতেও ভোলেন না। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য কিছু কিছু আইন অমান্য করার তাগিদ দেন। শুধু নিজের দেশেই নয়, পৃথিবীর সব দেশেই যেন এমনটি হয়, তিনি সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন : 

'স্বাধীনতার ঘোষণায় যে নীতি, লক্ষ্য ও স্পিরিট আছে আমরা সেখানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এ স্পিরিট অবৈধ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। এই স্পিরিট সেই শক্তির বিরুদ্ধে যা মানুষদের তাদের জীবন, স্বাধীনতা, ও সুখ খোঁজার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তাই এই পরিস্থিতিতে এটা বর্তমান সরকারকাঠামোকে বদলে দেওয়ার বা বিলুপ করার তাগিদ দেয়। তবে বিলুপ্ত করার ওপরই বেশি জোর দেয়। কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণার নীতিগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, আমাদেরকে আইনের বাইরে যেতে হবে। যে আইন হত্যা, সম্পদের অসম বণ্টন, সামান্য অপরাধে মানুষকে জেলে পোরা, ভয়ংকর অপরাধীদের জেলের বাইরে রাখা- এসব বিষয়কে মদদ দেয়, সেই আইন মানা বন্ধ করতে হবে। আমার আশা হচ্ছে: এই ধরনের স্পিরিট শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই প্রতিষ্ঠিত হবে, কারণ এটা সবারই প্রয়োজন। সব দেশের মানুষের মধ্যেই রাষ্ট্রকে অমান্য করার এই স্পিরিট থাকা প্রয়োজন। এবং একই লক্ষ্যে সংগ্রামরত সব দেশের জনগণের জন্য ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্সের মতো একটা কিছু থাকা প্রয়োজন।'

প্রিয় পাঠক, সব জাতির থাকে না, কিন্তু আমাদেরও একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আছে। সেখানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, "জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি"। একবার ভেবে দেখুন তো, আমাদের রাষ্ট্র সেই ঘোষণায় স্থির আছে কি না? নাকি বহুদূরে সরে এসেছে? সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার কি কোথাও দেখতে পান? কী মনে হয়? ভাবুন, প্রশ্ন করুন।

Comments