পৃথিবীতে কবিতা নিয়ে উন্মাদনা কেটে গেছে : জো উইন্টার

জো উইন্টার একজন ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ও কবি। তিনি ১৯৪৩ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ এই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য বিখ্যাত। 'গীতাঞ্জলী' ও 'রূপসী বাংলা'সহ মোট সাতটি কবিতার বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন তিনি।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার তাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ পদক তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। পদক হিসেবে ১৮ ক্যারেট মানের ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, সম্মাননাপত্র এবং চার লাখ টাকা কিংবা সমমূল্যের ডলার দেওয়া হয়

সম্প্রতি বাংলাদেশ, কবিতার অনুবাদ ও তার পুরস্কার নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন জো উইন্টার। 

বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেলেন, কেমন লাগছে?

আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও অভিভূত। আমার কাজের স্বীকৃতি পেলাম। 

ঢাকা শহর কেমন দেখলেন?

ঢাকা আমার কাছে কলকাতার মতো। সেখানে আমি ১২ বছর কাটিয়েছি। কলকাতায় থাকাকালীন কিছু কবিতা লিখেছি, যেগুলো 'ক্যালকাটা পোয়েমস' নামে আখ্যায়িত। এগুলো গেস্ট অ্যান্ড হোস্ট প্রচ্ছদনামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকায় অনেক বিচিত্র দৃশ্য ও স্থান রয়েছে, এগুলো আমাকে ভাবায় ও দোলায়। এখানকার সবই আমাকে মুগ্ধ করছে। মনে হয়েছে 'জীবনের তীরে নতুন ঢেউ আছড়ে পড়ছে'।

'রূপসী বাংলা' ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন,‌ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে পরিচয় কবে কীভাবে?

কলকাতায় থাকার সময় অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, যারা শিল্পসাহিত্যের মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমি কাজ করছি জেনে তারা আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। অনেকে বলেছেন, কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়তে। ‌আমি বলেছি না। ‌ তিনি একজন আধুনিক কবি। ‌কবিতায় আধুনিকতাবাদ ঠিক আমার মনঃপুত না।‌ তারপর আমার একজন বন্ধু জ্যোতির্ময় দত্ত আমাকে 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি পড়ে দেখতে বললেন।‌ কবিতাটি বুঝতে তিনি সাহায্য করলেন। ‌'মৃত্যুর আগে' আমাকে অভিভূত করল।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ পদক তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

সন্দেহ নেই জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কবি, কিন্তু তার কবিতার পঙক্তিতে এমন ছান্দসিকতা আছে, এমন মাধুর্য আছে—যা গীতি কবিতার মতো।‌ তারপর আমি তার আরও কবিতা পড়তে শুরু করি এবং অনুবাদ শুরু করলাম। এক সময় আমি রূপসী বাংলার কবিতাগুলো পড়ি এবং একে একে রূপসী বাংলার সনেটগুলো অনুবাদ করতে থাকি। এক সময় পুরো বই অনুবাদ করি। রূপসী বাংলার সনেটগুলো জীবনানন্দ দাশের অন্যান্য কবিতার স্রোত থেকে আলাদা। এখানে তিনি খুব বেশি ইন্দ্রিয় স্নিগ্ধ। আমি মনে করি কবি জীবনানন্দ দাশ কেবল বাংলা ভাষার নন, সারা পৃথিবীর বিংশ শতাব্দীর নিখাদ একজন আধুনিক কবি।

জীবনানন্দ দাশের কতগুলো কবিতা অনুবাদ করেছেন?

আমি বেছে বেছে তার বিভিন্ন কবিতার বই থেকে ৫০টি কবিতা অনুবাদ করেছি। এগুলো যে বইয়ে প্রকাশ করেছি তার নাম 'নেকেড লোনলি হ্যান্ড', নগ্ন নির্জন হাত। আমি মনে করি জীবনানন্দ দাশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য এই পঞ্চাশটি কবিতা যথেষ্ট।‌ যারা আমার অনুবাদের সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের সবাইকে বলব—এই বইটির অনুবাদগুলো পড়ে দেখার জন্য। একইসঙ্গে মূলের প্রতি বিশ্বস্ত ও মাধুর্যময় অনুবাদের জন্য আমাকে বিশেষভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল।‌ আমি প্রতিটি কবিতা একজন বাঙালি কবিতাবোদ্ধার সাহায্য নিয়ে পড়েছি, যেন আক্ষরিক অনুবাদের কারণে কবিতার প্রাণ হারিয়ে না যায়।‌ সঠিক অনুবাদের জন্য কবিতার মর্মমূলে প্রবেশ করা দরকার। ‌কবিকে আদ্যোপান্ত অনুভব করা দরকার। এটি একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ‌আমি যথেষ্ট সময় নিয়ে এই কাজটি করেছি। আপনি কি আমার অনুবাদ পড়েছেন? আমি অনুরোধ করব প্রথমে নেকেড লোনলি হ্যান্ডের কবিতাগুলোর অনুবাদ পড়ার জন্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশকে বিশ্ব সাহিত্যের পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে আপনি বাংলা ভাষা শিখেছেন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পুরস্কার পেলেন? 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ দুজনে দুইভাবে আমাকে অভিভূত করেছে। তাদের কবিতায় অবগাহন করে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বদলে গেছে। আমি যেমন তাদের কবিতাকে ভালোবেসেছি, তেমনি যে ভাষায় তারা কবিতা লিখেছেন—সেই ভাষাকেও ভালোবেসেছি। ‌২০০৬ সালে আমি কলকাতা ছেড়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যাই।‌ তারপর বাংলা ভাষার চর্চা কমে যায়।‌ কিন্তু, এটা ঠিক, বাংলা ভাষার যে শক্তিমত্তা তা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। বাংলা ভাষা পৃথিবীর বহুল চর্চিত ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম।‌ যারা বাংলা ভাষা শিখবেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গভীরে প্রবেশ করবেন, তারা বুঝতে পারবেন—বাংলা ভাষার পরিণত রূপটি কতটা সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্য আরও অনুবাদ হওয়া দরকার।

আপনি একজন কবি, এ পর্যন্ত আপনার কতগুলো কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে?

মনে হয়, কবিতার পাঠক সংখ্যা ক্রমশ কমছে। সেলিব্রেটি কবি বাদ দিলে অন্যদের কবিতার বই খুব একটা বিক্রি হয় না। বাংলাদেশে ত্রিশ চল্লিশ পঞ্চাশের দশকে কবিতা নিয়ে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা ছিল। ‌সারা পৃথিবীতে কবিতা নিয়ে এক সময় উন্মাদনা দেখা যেত। আমার মনে হয় সেই উন্মাদনা কেটে গেছে।‌ কবিতার গভীরে ডুব দিয়ে আনন্দ পাওয়া মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। আমি কবিতা লিখি না, ‌কবিতা একটি অন্তর্জাত উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিকে আমি কাগজে-কলমে লিখে রাখি। আমার মনে হয়, প্রত্যেক শুদ্ধ কবি এমন একটি প্রক্রিয়ায় কবিতা লেখেন।

এবার বাংলাদেশ সফর আপনার কেমন লাগছে, স্মৃতি থাকবে? 

২০১৬ সালে আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলাম, তখন বাংলা একাডেমি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেবার এসে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।‌ তাদের সঙ্গে আড্ডায় আড্ডায় সময় কেটেছিল। সেবার একা বরিশাল গিয়েছিলাম। সেখানে কিছুদিন বেড়িয়েছি, জীবনানন্দ দাশের জন্মভূমি দেখেছি। তার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের স্মৃতির নানা জায়গা ঘুরেছি।‌ রূপসী বাংলায় যেমন পড়েছি, সেখানে তেমন নৈসর্গিক পটভূমি পেয়েছি।‌ বাংলাদেশের মানুষকে মনে হয়েছিল, পুরনো পৃথিবীতে নতুন আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় উচ্ছল একটি জাতিগোষ্ঠী। এবার এসেছি একটি গণঅভ্যুত্থানের পর।

একাধিক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার কথা আছে। কিছুদিন আগে সমকাল পত্রিকায় আমার একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। আরেকটি পত্রিকায় আমার নেকেড লোনলি হ্যান্ড নিয়ে আলোচনা ছাপা হয়েছে। এগুলো সংগ্রহ করেছি, ইংল্যান্ডে নিয়ে যাব। তবে ভাষাগত পার্থক্যের জন্য সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারছি না।‌ আশা করি, যে কয়দিন থাকব দিনগুলো ভালো কাটবে। ‌ নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে, যারা কবিতা ভালোবাসেন, গান ভালোবাসেন।

আপনি এবার বইমেলা ঘুরলেন, কেমন লেগেছে বাংলাদেশের বইমেলা?

হ্যাঁ, অনেক মানুষের সমাগম বাংলাদেশের বইমেলায়। এখন প্রাণের উচ্ছ্বাস অন্যরকম। এবার ‌বইমেলায় ঘুরেছি। কিন্তু কম মানুষের হাতে বই দেখেছি। তবে মেলায় পাঠকের উচ্ছ্বাস ভালো লেগেছে। আমি দুটি কবিতার বই কিনেছি।

Comments

The Daily Star  | English

NBR plans to roll back tax benefits for exporters

The prospect of reduced tax benefits has rattled exporters, already wrestling with shifting global trade dynamics, including fresh US tariffs

11h ago