শোষণের বিরুদ্ধে কবি ফররুখ আহমদ

বাংলা সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র ও শক্তিমান কবি ফররুখ আহমদ। তার কাব্যভাষা কেবল নান্দনিক উৎকর্ষেই ভাস্বর নয়, বরং তা একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন আত্মপরিচয় নির্মাণের অভিপ্রায় থেকেও উৎসারিত। সামাজিক সংকটে, শোষণের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার কবি ফররুখ আহমদ।
তার কবিতায় যে নতুন কাব্যভাষার উন্মেষ ঘটে, তাকে নয়া-ইতিহাসবাদের আলোকে বিশ্লেষণ করলে সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ক্ষমতার অন্তর্জাল এবং কবির সৃষ্টিশীল প্রতিক্রিয়ার এক গভীর চিত্র উন্মোচিত হয়। নয়া-ইতিহাসবাদ সাহিত্যকে নিছক শিল্পকর্ম হিসেবে না দেখে তাকে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তেও উৎপাদন এবং সেই মুহূর্তেও ক্ষমতার বিন্যাস, সামাজিক বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি ও প্রতিস্পর্ধী হিসেবে পাঠ করে। এই তাত্ত্বিক কাঠামোর নিরিখে ফররুখ আহমদের কাব্যভাষ্য নির্মাণের প্রয়াস এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
ইতিহাসবাদের মূল প্রতিপাদ্য হলো সাহিত্য ও ইতিহাস পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সাহিত্য যেমন ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত হয়, তেমনি ইতিহাসও সাহিত্যের মাধ্যমে নতুনভাবে পঠিত ও নির্মিত হতে পারে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো সাহিত্যকর্ম তার সমকালীন 'এপিস্টেম' বা জ্ঞান-কাঠামোর বাইরে যেতে পারে না এবং তা অনিবার্যভাবেই সেই সময়ের ক্ষমতা-সম্পর্কের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। ফররুখ আহমদের কাব্য জীবনের উন্মেষকাল ছিল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের এক ক্রান্তিলগ্ন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তিম পর্যায়, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ এবং নবগঠিত পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা—এই জটিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তার কাব্যভাষাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত ও নির্মাণ করেছে।
ফররুখ আহমদের নতুন কাব্যভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাংলা ভাষার চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আরবি, ফরাসি ও উর্দু শব্দের সুষম ও শৈল্পিক সমন্বয়। এটি নিছক শব্দঋণ নয়, বরং একটি সচেতন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ। তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে সাংস্কৃতিক বাংলা ভাষার যে প্রবল প্রভাব ছিল, তার বিপরীতে তিনি এমন একটি ভাষা নির্মাণ করতে চেয়েছেন যা বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুষঙ্গকে ধারণ করতে সক্ষম।
ইতিহাসের দৃষ্টিতে, এই ভাষিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আসলে একটি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। 'সাত সাগরের মাঝি' বা 'সিন্দবাদ' কবিতায় ব্যবহার 'কিশতি', 'দরিয়া', 'সারঙ্গি', 'জোয়ার', 'তসবির', 'বেসাতি', 'মারজান', 'মর্মর', 'জামরুদ', 'হেরার রাজ-তোরণ', 'আফতাব', 'আজদাহা' ইত্যাদি শব্দ শুধুমাত্র কাব্যিক অলংকরণ নয়, এগুলো একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে বাংলা ভাষার শরীরে আত্মস্থ করার প্রয়াস। এই শব্দাবলী একদিকে যেমন ইসলামিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পাঠককে সংযুক্ত করে, তেমনি অন্যদিকে বাংলা ভাষার প্রচলিত কাব্যিক আভিজাত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
'উৎসর্গ পাতা' কবিতায় 'পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি'র উল্লেখ এবং 'কয়েকটি আদর্শ-দীপ্ত দিনের স্মরণে' পঙক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সরাসরি কবির সমকালীন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও তার সঙ্গে কবির সম্পৃক্ততার দিকে ইঙ্গিত করে। নয়া-ইতিহাসবাদ এই ধরনের 'অ্যানেকডট' বা প্রান্তিক তথ্যকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেয়, কারণ এগুলো কবির সৃষ্টিশীলতাকে তার ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই রেনেসাঁসের আকাঙ্ক্ষা ছিল মুসলিম ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করা। ফররুখের কাব্যভাষা এই জাগরণেরই ভাষিক অভিব্যক্তি। তিনি যে, 'উজ্জ্বল দিন' বা 'সুতীব্র-প্রয়াস'-এর কথা বলছেন, তা নিছক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, বরং একটি সমষ্টিগত স্বপ্নের প্রতিধ্বনি, যা তৎকালীন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতার বিন্যাসে একটি নতুন অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছিল।
ফররুখ আহমদের কাব্যভাষা নির্মাণের আরেকটি দিক হলো ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক মিথ, উপমা ও রূপকের সচেতন প্রয়োগ। 'সাত সাগরের মাঝি' কবিতায় ঘুমন্ত মাঝিকে জাগানোর যে আকুতি, তা আসলে ঔপনিবেশিক ও তৎপরবর্তীকালে হতোদ্যম মুসলিম সমাজকে তাদের গৌরবময় অতীত স্মরণ করিয়ে দিয়ে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার আহ্বান। 'হেরার রাজ-তোরণ' শুধু একটি স্থানবাচক শব্দ নয়, এটি জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও নবজীবনের প্রতীক।
ইতিহাসবাদের আলোকে দেখলে, এই প্রতীকগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে কবি একটি 'কাউন্টার-ন্যারেটিভ' বা প্রতি-আখ্যান তৈরি করেছেন। ঔপনিবেশিক শক্তি যে ইতিহাস ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছিল, তার বিপরীতে তিনি নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে বিকল্প বিশ্ববীক্ষা তুলে ধরছেন। 'রুস্তম' বা 'সরফদ দেও'-এর মতো প্রসঙ্গগুলো পারস্যের মহাকাব্যিক ঐতিহ্যকে বাংলা কাব্যের অংশ করে তোলে, যা সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
'লাশ' কবিতাটি নয়া-ইতিহাসবাদের আলোকে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। 'তেরশো পঞ্চাশে' বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত এই কবিতাটি সমকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের এক নির্মম দলিল। কবি যে 'স্ফীতোদর বর্বর সভ্যতা' বা 'জড় সভ্যতা'র কথা বলেছেন, তা নিছক বিমূর্ত কোনো ধারণা নয়, বরং তৎকালীন ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী শোষণ-ব্যবস্থা এবং তার সহযোগী দেশীয় সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতি প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। এই কবিতায় ব্যবহৃত রূঢ়, বাস্তব শব্দ ('পিশাচ', 'দস্যু', 'আজাজিল', 'ক্ককুর, ক্ককুরী') এবং শ্লেষাত্মক ভঙ্গি প্রচলিত কাব্যিক কমনীয়তা থেকে সরে এসে এক নতুন, প্রতিবাদী কাব্যভাষার জন্ম দিয়েছে। এখানে ভাষা শুধুমাত্র ভাবের বাহন নয়, ভাষা নিজেই এক ধরনের সামাজিক সমালোচনা ও প্রতিবাদের অস্ত্র। নয়া-ইতিহাসবাদ মনে করে, সাহিত্যকর্মগুলো প্রায়শই তাদের সময়ের ক্ষমতার কাঠামোকে প্রতিফলিত করে বা প্রশ্নবিদ্ধ করে। 'লাশ' কবিতাটি সেই ক্ষমতার কাঠামোকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
'পাঞ্জেরী' কবিতায় ব্যবহৃত 'আসমান', 'সেতারা', 'হেলাল', 'জিন্দিগানীর বা'ব', 'মর্সিয়া', 'খা'ব', 'জুলমাত' ইত্যাদি শব্দবন্ধ এক বিষণ্ণ, অনিশ্চিত সময়ের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। এটিও তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা ও দিগভ্রান্তির শৈল্পিক প্রকাশ। এখানেও কাব্যভাষা সমকালীন ঐতিহাসিক সংকট থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
'মন' কবিতায় কবি যখন বলেন, 'তোমার অরণ্যে আজ পুরাতন বনস্পতি/ ছাড়িয়াছে বিশীর্ণ বল্কল', তখন এই 'বিশীর্ণ বল্কল' ত্যাগ আসলে ঔপনিবেশিকতার জীর্ণ কাঠামো ও মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এই আকাঙ্ক্ষা একটি নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন, যা ফররুখ আহমদের কাব্যভাষার অন্যতম চালিকাশক্তি।
'শাহরিয়ার' বা 'জিন্দাবাদ' কবিতায় আরব্য রজনীর অনুষঙ্গ ব্যবহার করে ফররুখ আহমদ সমকালীন সংকট ও উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছেন। অত্যাচারী শাহরিয়ারের অনুশোচনা বা সিন্দাবাদের দুঃসাহসিক অভিযাত্রা নিছক গল্পকথা নয়, বরং এগুলো রূপকের আশ্রয়ে জাতির আত্মশুদ্ধি ও নবযাত্রার আহ্বান। 'সিন্দাবাদ' কবিতায় 'মাতমি-লেবাস ফেলে আজ পরো মল্লার নীল সাজ' এই পঙক্তিটি শোক বা নিষ্ক্রিয়তা পরিহার করে কর্মোদ্যোগী হওয়ার প্রত্যক্ষ ডাক। এই কাব্যভাষা তাই কেবল অতীতের রোমন্থন নয়, বরং অতীত থেকে প্রেরণা বর্তমানকে মোকাবিলা করে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার ভাষা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি লেখককে একক প্রতিভাধর স্রষ্টা হিসেবে না দেখে তাকে একটি সাংস্কৃতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখে। ফররুখ আহমদ তার কাব্যভাষা নির্মাণে সমকালীন বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে একটি নীরব সংলাপে লিপ্ত ছিলেন। তার কাব্যভাষা তাই একক সৃষ্টি নয়, বরং একটি সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার শৈল্পিক রূপায়ন।
পরিশেষে বলব, ফররুখ আহমদের কবিতায় যে নতুন কাব্যভাষার সৃষ্টি হয়েছে, তা ইতিহাসবাদের আলোকে বিচার করলে এক গভীর তাৎপর্য লাভ করে। এই কাব্যভাষা নিছক নান্দনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে একটি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়, স্বাতন্ত্র্য ও ক্ষমতায়নের ভাষিক হাতিয়ার। আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের শৈল্পিক আত্তীকরণ, ইসলামিক মিথ ও ঐতিহ্যের নবায়ন এবং সমকালীন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বর—এই সব মিলিয়ে ফররুখ আহমদ বাংলা কাব্যে এমন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন, যা তার সময়কে ধারণ করেও কালোত্তীর্ণ। তার কাব্যভাষা সেই সময়ের 'টেক্সট' যা সমকালীন ইতিহাসের 'কনটেক্সট' থেকে অবিচ্ছেদ্য এবং এই মিথস্ক্রিয়াই তার ভাষাকে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য।
Comments