১৫৪ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন

দূতাবাস কর্মকর্তা ছাড়াও সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২ কর্মকর্তা ও ৮ বাংলাদেশি গ্রেপ্তার

সৌদি সরকারের তদারকি ও দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ বা নাজাহা বেশ কয়েকটি টুইটবার্তায় ৫ কোটি ৪০ লাখ সৌদি রিয়াল বা প্রায় ১৫৪ কোটি টাকার এই ঘুষ লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করেছে এবং গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। 
সৌদি আরবের তদারকি ও দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের (নাজাহা) টুইটার পেজ থেকে নেওয়া।

ঘুষ নিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে সৌদি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের দুই সাবেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২ কর্মকর্তা ও ৮ বাংলাদেশিসহ অন্তত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সৌদি আরবের তদারকি ও দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ।

দেশটির জাতীয় তদারকি ও দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ বা নাজাহা বেশ কয়েকটি টুইটবার্তায় ৫ কোটি ৪০ লাখ সৌদি রিয়াল বা প্রায় ১৫৪ কোটি টাকার এই ঘুষ লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করেছে এবং গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। 

সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দিতে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের কনস্যুলার বিভাগের সাবেক প্রধান ও উপরাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ ফালাহ মুদাহি আল-শামারি এবং কনস্যুলার বিভাগের উপপ্রধান খালেদ নাসের আয়েদ আল-কাহতানি ৫ কোটি ৪০ লাখ সৌদি রিয়াল ঘুষ নিয়েছেন।

'তারা সৌদি আরবে গ্রেপ্তার বাংলাদেশিদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের কিছু অংশ নিজেরা নিয়েছে এবং বাকিটা দেশের বাইরে বিনিয়োগ করেছে বলে স্বীকার করেছে,' কর্তৃপক্ষ বলছে।

এ ঘটনায় একটি ফৌজদারি মামলার কাজ শুরু হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো-টলারেন্স' নীতিতে আইনের প্রয়োগ করবে বলে জানানো হয়েছে।

নাজাহা জানায়, 'কেউ সরকারি দপ্তরকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলে বা জনগণের স্বার্থ নষ্ট করলে, অবসরে গেলেও তাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে, কারণ এ ধরনের অপরাধের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।'

এই ১৩ জনকে ঠিক কখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে সৌদি দূতাবাসের যে দুই সাবেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের প্রায় ২ মাস আগে বরখাস্ত করে সৌদি আরবে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

নাজাহা টুইটে জানায়, দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে মন্ত্রণালয়ের ২ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। এক বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ৬০ হাজার সৌদি রিয়াল পেয়ে এক বাসিন্দাকে (বাংলাদেশিকে) বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ২ কোটি ৩০ লাখ সৌদি রিয়াল বা প্রায় ৬৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার (প্রতি রিয়াল ২৮ দশমিক ৫ টাকা ধরে) আর্থিক চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-কোর্ট সিকিউরিটির সার্জেন্ট (রিয়াদ অঞ্চলের পুলিশ) মেতাব সাদ আল-ঘনুম, রিয়াদের স্পেশাল মিশন ফোর্সের করপোরাল হাতেম মাসতুর সাদ বিন তাইয়েব এবং বিনিয়োগকারী ফিলিস্তিনি নাগরিক সালেহ মোহাম্মদ সালেহ আল-শালাউত।

অধিকতর তদন্তের পর বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে আশরাফ উদ্দিন আকন্দ, আলমগীর হোসেন খান এবং শফিক আল ইসলাম শাহজাহানের নাম জানিয়েছে নাজাহা।

তারা বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাসের কর্মচারীদের যোগসাজশে অবৈধ ভিসা বাণিজ্যে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে।

টুইটে বলা হয়, 'তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ২ কোটি ১ লাখ ৮০ হাজার সৌদি রিয়াল, স্বর্ণের বার, বিলাসবহুল গাড়ি পাওয়া গেছে। এগুলো তারা অবৈধ ভিসা বাণিজ্যের মাধ্যমে আয় করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছ।'

পরে অবৈধ ভিসা বাণিজ্য এবং সৌদি থেকে অর্থপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশটিতে অবস্থানরত আরও ৫ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন বাংলাদেশের একটি রিক্রুটমেন্ট অফিসের মালিক মোহাম্মদ নাসের উদ্দিন নূর, আল আমীন খান, জায়েদ উওসিয়েদ মাফি, আবুল কালাম মোহাম্মদ রফিক আল ইসলাম ও আজিজ আল হক।

আরও তদন্তের পর বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাসের ওই দুই সাবেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রোববার দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশে সৌদি রাষ্ট্রদূত এসা ইউসুফ কোনো মন্তব্য করেননি।

যেভাবে এই ঘুষ লেনদেন

ঢাকার সূত্রগুলো দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, কর্মী ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে প্রায় ২ মাস আগে সৌদি দূতাবাসের ৩ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

তাদের মধ্যে দুজনকে পরে সৌদি আরবে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তৃতীয় কর্মকর্তার নাম জানা যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে সৌদির দুর্নীতিবিরোধী কর্তৃপক্ষ (নাজাহা) অনুসন্ধান চালায় এবং বাংলাদেশের কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে। তবে এজেন্সিগুলো ভয়ে তাদের নাম প্রকাশ করেনি।

তারা জানিয়েছে, প্রায় এক বছর আগে ঢাকার সৌদি দূতাবাস রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো থেকে প্রতিটি ভিসা দেওয়ার জন্য ২২০-২৫০ মার্কিন ডলার আদায় করত।

একজন রিক্রুটিং এজেন্ট জানান, হঠাৎ করে সৌদি দূতাবাস একটি নিয়ম করে যে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি সপ্তাহে ২০টির বেশি ভিসা আবেদন জমা দিতে পারবে না। একটি এজেন্সি সপ্তাহে মাত্র একবার ভিসা আবেদন করতে পারে।

কিন্তু অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি সপ্তাহে কয়েকশ পাসপোর্ট নিয়ে কাজ করে। ভিসা পেতে এই এজেন্সিগুলো সমস্যায় পড়ে যায়। এজেন্সিগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মীদের ভিসা পাইয়ে দিতে মরিয়া হওয়ায় দূতাবাসের কর্মীরা টাকা নেওয়া শুরু করে।

একজন রিক্রুটিং এজেন্ট ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এভাবে টাকার বিনিময়ে সৌদি ভিসা দেওয়া শুরু হয়। সংকট থাকার পরও তাদেরকে ডলারে অর্থ দিতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সৌদি কর্মকর্তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর পর ঘুষ আদায় বন্ধ হয়ে যায়।'

সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ গত বছর অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে গত বছর ৬ লাখ ১২ হাজারের বেশি শ্রমিক সৌদি আরবে গেছেন। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে গেছেন ৮৫ হাজার ৩১৯ জন।

তবে দেশটিতে প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করলেও, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হার গত ৬ মাসে কমে গেছে।

২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে সৌদি থেকে বাংলাদেশিদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৯১০ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ কম।

এর আগে জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৯৯৯ দশমিক ০.১ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ৪  শতাংশ কম।

 

Comments

The Daily Star  | English
No respite from heat wave for five days: BMD

Heat takes a toll on expecting mothers

The ongoing heatwave has exacerbated the challenges faced by everyone in the country, but the situation has become particularly difficult for expecting mothers.

1h ago