সরকার পতনের আন্দোলন: গ্রেপ্তার হচ্ছেন পরিবারের সদস্যরাও

তবে পুলিশ গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সহিংসতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কাজ করছে বলে জানিয়েছে।
প্রতীকী ছবি

বিএনপির ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ ঘোষণার পরপরই, গ্রেপ্তার এড়াতে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের নারায়ণগঞ্জ শাখার সদস্য সচিব সালাউদ্দিন সালো তার বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

পরিবারের সদস্যরা জানান, পাঁচ দিন পর ২ নভেম্বর রাতে ২৮ অক্টোবর কাঁচপুর এলাকায় ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা ও স্থানীয় পুলিশ কাঁচপুর ইউনিয়নের সেনপাড়া এলাকায় সালাউদ্দিনের বাড়িতে যায়।

সালাউদ্দিন বাড়িতে না থাকায় এরপর পুলিশ সালাউদ্দিনের শ্বশুরবাড়ি বেহাকৈর গ্রামে যায়। যেখানে তার শ্বশুর ইসহাক ভূঁইয়া (৬৫) বসবাস করেন।

এরপর পুলিশ কাঁচপুর এলাকায় সালাউদ্দিনের শ্বশুর ইসহাকের ইলেকট্রনিক্সের দোকানে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে। পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ৫ নভেম্বর কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার দুই ছেলেকেও পরদিন একই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

'বিএনপির সঙ্গে আমার শ্বশুরের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। তারপরও আমাকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশ তাকে আটক করেছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও তিনি এই মামলায় অভিযুক্তও ছিলেন না,' এক টেক্সট বার্তায় সালাউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে এসব কথা বলেন।

তবে এটিই একমাত্র ঘটনা নয় যেখানে পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের গ্রেপ্তার বা হয়রানি করছে।

দ্য ডেইলি স্টার এ ধরনের চারটি ঘটনার কথা জানতে পেরেছে যেখানে পুলিশ সন্দেহভাজনদের ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে।

তবে পুলিশ গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সহিংসতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কাজ করেছে বলে দাবি করেছে।

'বিএনপির রাজনীতি করা অপরাধ নয়'

ইসহাকের মেয়ে তানিয়া আক্তার জানান, গত রোববার বিকাল ৫টার দিকে কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পর দুই ভাই নয়ন ভূঁইয়া (৪২) ও সুমন ভূঁইয়ার (৪১) খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।

নয়ন স্থানীয় বিএনপি নেতা হলেও সুমন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় উল্লেখ করে তানিয়া বলেন, পরে তিনি জানতে পারেন তার দুই ভাই পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।

তিনি বলেন, 'বিএনপির রাজনীতি করা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু আমার স্বামী (সালাউদ্দিন) বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আমরা সমস্যার মুখে পড়েছি। আমরা এমনকি স্বস্তিতে থাকতে পারছি না। গত ১৫ দিনে আমার স্বামীকে খুঁজতে বেশ কয়েকবার পুলিশ আমাদের বাড়িতে এসেছে।'

তাদের অন্তত তিন জন প্রতিবেশী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ইসহাক ও সুমনের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই।

সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম জানান, ইসহাকের নাম এফআইআরে না থাকলেও গত ২৮ অক্টোবর রাতে তিনি ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের মুখপাত্র চাইলু মারমা জানান, ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ইসহাকের দুই ছেলে নয়ন ও সুমনকেও একই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মামলার অপর আসামি সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি পীর মোহাম্মদ পিরু। তার বড় ছেলে সালেহ মোহাম্মদ শান্ত (২৯) নয় মাস আগে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন তাকেও মামলার আসামি করা হয়েছে।

পিরু জানান, গত ৩০ অক্টোবর তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশ তার বাড়িতে আসে।

তিনি বলেন, 'আমরা শুনেছি পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের পুরুষ আত্মীয়দের গ্রেপ্তার করছে। আমি ও আমার ছোট ছেলে এখন এ ধরনের গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।'

'আতঙ্কের মধ্যে বাস করছি'

গত ৩১ অক্টোবর রাতে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আশফাক ও তার ছেলে ছাত্রদল নেতা আনান ইসলাম আকাশকে গ্রেপ্তারের জন্য তার বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ।

তারা বাড়িতে ছিলেন না এবং পুলিশ আশফাকের যমজ ছেলে শহিদুল ইসলাম অনিক এবং মাকসুদুল ইসলাম আবিরকে গ্রেপ্তার করে, বলে জানায় পরিবারের সদস্যরা।

পরদিন তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।

আবির স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং অনিক এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

'আমি আপনাদের আশ্বস্ত করে বলতে পারি যে, আমার যমজ ছেলেরা রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। এমনকি স্থানীয় পুলিশও এটা জানে,' বলেন আশফাক। যিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'আমার পরিবার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।'

তার দুই প্রতিবেশী জানিয়েছেন, তারা কখনও শোনেননি যে আমিনুল ইসলামের যমজ দুই ছেলে রাজনীতি বা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত।

কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দাউদ জানান, গত ২৯ অক্টোবর কিশোরগঞ্জে বিএনপির অবরোধ চলাকালে হামলা ও ভাঙচুরের মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ওই দুই যমজ ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের পরদিন রাজধানীর গুলশানে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের বাসায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ।

তিনি বাড়িতে না থাকায় পুলিশ তার ছোট ভাই ইশফাক হোসেন ও গাড়িচালক রাজীবকে আটক করে।

গ্রেপ্তারের পর ইশরাকের মা ইশমত আরা বলেন, তার ছোট ছেলে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় এবং তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই।

এছাড়াও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালামের একান্ত সহকারী ফারুকুল ইসলাম সেলিমকে এক সপ্তাহ আগে শান্তিনগর এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের লোকজন।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের উপ-মহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন বলেন, কোনো নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে।

'আমরা স্পষ্টভাবে আমাদের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি যে শুধুমাত্র সহিংসতা বা কোনো অপরাধ বা অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য কোনো অবস্থাতেই হয়রানির শিকার হবেন না। অন্য কারো অপরাধের জন্য কাউকে দায়ী করা হবে না,' গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

কিশোরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি স্থানীয় পুলিশ সুপারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, যারা তাকে জানিয়েছেন যে আটককৃতরা ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুই যমজ ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ মামলায় এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া অন্য সন্দেহভাজনরা পুলিশের কাছে তাদের নাম বলেছে।

সালাউদ্দিনের শ্বশুর ইসহাকের গ্রেপ্তারকে সমর্থন করে তিনি বলেন, ইসহাক ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তার দুই ছেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, বিএনপি নেতাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

(আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম এই প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন)

Comments