ভ্যানচোর সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা: ‘মবের ভয়ে’ ঘটনাস্থল থেকে ফিরে এসেছিল পুলিশ

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায় যখন রূপলাল ও প্রদীপকে মারধর করা হচ্ছিল, সে সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
আরও অভিযোগ উঠেছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পুলিশের ছিল, কিন্তু তারা সেটি করেনি।
তবে, নিজেদের রক্ষা করতে বাধ্য হয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে হয়েছিল বলে দাবি করেছে পুলিশ।
অন্তত ১২ জন প্রত্যক্ষদর্শী দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, দুটি ভ্যানে ১২-১৪ জন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক চাল ব্যবসায়ী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। রাত তখন প্রায় ৯টা, ক্ষুব্ধ লোকজন দুই ব্যক্তিকে ঘিরে রেখে মারধর করছিল। ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে সেখানে পুলিশের দুটি ভ্যান আসে। ১২-১৪ জন পুলিশ হবে। তারা ভিড়
ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পুলিশকে দেখে লোকজন আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।'
'আনুমানিক ১০ মিনিট অপেক্ষা করে পুলিশ চলে যায়। রাত প্রায় সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনী আসে। তখন লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আমিও চলে আসি,' বলেন তিনি।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী কলেজছাত্র পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'পুলিশ চাইলে দুই ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারতো, কিন্তু পুলিশ ভয়ে অস্থির হয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।'
তার দাবি, মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবু জোবায়ের ঘটনাস্থলে এসেছিলেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জোবায়ের ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলাম কি না মনে করতে
পারছি না। তবে ঘটনার সময় অনেক পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়েছিল।'
কারা উপস্থিত ছিলেন জানতে চাইলে কারও পরিচয় জানাতে রাজি হননি জোবায়ের।
সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুর হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুই ভ্যান পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল, কিন্তু তারা দুই ব্যক্তিকে রক্ষা না করে চলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পুলিশের ছিল, কিন্তু
তারা সেটি করেনি।'
'ঘটনাস্থল থানা থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। দ্রুত আরও বেশি সংখ্যক পুলিশ পাঠানো সম্ভব ছিল,' দাবি হামিদের।
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশ চলে যাওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা পর রাত ১১টার দিকে সেনাবাহিনী সহযোগিতায় পুলিশ আবার
ঘটনাস্থলে যায়। তখন গণপিটুনিতে একজন মারা গেছেন, আরেকজন মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিলেন।'
যোগাযোগ করা হলে তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেদিন পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল, কিন্তু সংখ্যায় কম ছিল। জনতা সংখ্যায় ছিল দুই-তিন হাজার, তারা পুলিশকে মারতে তেড়ে এসেছিল। পুলিশ নিজেদের রক্ষা করতে বাধ্য হয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিল।'
'খবর পেয়ে আমি সেনাবাহিনীকে জানাই এবং সেখান গিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে আহত দুই ব্যক্তিকে উদ্ধার করি। তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ মারা যান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে,' বলেন ফারুক।
গণপিটুনিতে নিহত দুজন হলেন—তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের রূপলাল দাস (৪০) এবং মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস (৩৫)। সম্পর্কে তারা জামাই-শ্বশুর ছিলেন। প্রদীপ পেশায় ভ্যানচালক এবং রূপলাল জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
প্রদীপের ছেলে দুলাল রবিদাস বলেন, 'আমার বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। ছয় বছর আগে অসুস্থতার কারণে তার ডান পায়ের গোড়ালি কেটে ফেলতে হয়েছিল। তাই তিনি ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালাতেন। ভ্যান চালিয়ে তিনি সংসার চালাতেন। সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতাও পেতেন। আমি দিনমজুরি করে সহায়তা করতাম।'
'আমার বাবা সম্পূর্ণ নিরাপরাধ মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো অবৈধ কোনো কাজ করতেন না,' বলেন দুলাল।
Comments