কুশিয়ারা পানিবণ্টন চুক্তি: উপকৃত হবে ৩ উপজেলার লক্ষাধিক কৃষক

কুশিয়ারা পানিবণ্টন চুক্তি: উপকৃত হবে ৩ উপজেলার লক্ষাধিক কৃষক
জকিগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর খালের বাঁধ। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে হওয়া ৭টি সমঝোতা চুক্তির মধ্যে অন্যতম কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি।

চুক্তি অনুযায়ী, কুশিয়ারা নদী থেকে রহিমপুর খাল দিয়ে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় শুকনো মৌসুমে চাষাবাদে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। একইসঙ্গে উপকৃত হবেন কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার কিছু অংশের কৃষক।

জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশীদ পয়েন্টে ভারতের বরাক নদী বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎপত্তি। এই পয়েন্টের আন্তর্জাতিক সীমান্ত ধরে বেশকিছু এলাকা অতিক্রম করে বিয়ানীবাজার উপজেলায় বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে।

কুশিয়ারার উৎসমুখ থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে শরীফগঞ্জ বাজারের পাশেই কুশিয়ারা নদী থেকে রহিমপুর খালটির উৎপত্তি। প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাকৃতিক খালটি আরও অনেক খালের উৎপত্তিস্থল।

কুশিয়ারা নদী থেকে এই খাল দিয়ে প্রবাহিত পানি কয়েক শতাব্দী ধরে জকিগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি ও হাওরাঞ্চল ছাড়াও কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার কিছু অংশের পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস।

তবে উৎসমুখে কুশিয়ারা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় গত কয়েক যুগ ধরে রহিমপুর খাল শুকনো মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এর কারণে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমিতে রবিশস্য ও আরও বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে বোরো চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছিল।

শুকনো মৌসুমে অনাবাদী থাকা জমিকে চাষযোগ্য করার লক্ষ্যে 'আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের' অধীনে ২০১০ সাল থেকে রহিমপুর খালের উৎসমুখে একটি পাম্প হাউজ নির্মাণ ও রহিমপুরসহ এই চেইনের বেশ কিছু খালের উন্নয়ন কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রকল্পের সুবিধার্থে ২০০৯ সালে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে খালের উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে খাল উন্নয়ন ও পাম্প হাউজের নির্মাণ কাজ শেষ করে পাউবো। রহিমপুর খালে পুনরায় পানি প্রবাহ চালু করলে উৎসমুখে নির্মিত বাঁধ অপসারণ করতে গেলে বাঁধা দেয় ভারত। কুশিয়ারার নদীর ঠিক মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা। এ কারণে এ নদীর বাংলাদেশের পাড় নো-ম্যানস ল্যান্ডের অংশ হওয়ায় ভারতের বাঁধার মুখে পড়ে বাঁধ অপসারণ কাজ।

কুশিয়ারা পানিবণ্টন চুক্তি: উপকৃত হবে ৩ উপজেলার লক্ষাধিক কৃষক
জকিগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর খালে ভরা মৌসুমেও প্রায় পানি শূন্য। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

বিষয়টি সুরাহা করতে ২০১৬ সাল থেকে ‍দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের বৈঠক শেষে গত ২১ আগস্ট যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে কুশিয়ারা নদী থেকে রহিমপুর খাল দিয়ে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় ও চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করা হয়।

মঙ্গলবার ওই খসড়া চুক্তির আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে চুক্তি সই হয়েছে।

রহিমপুর গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক বছর ধরে শুকনো মৌসুমে রহিমপুর খালে পানি না আসায় পাউবো পাম্প হাউজ নির্মাণের প্রশংসনীয় এ উদ্যোগটি নেয়। কিন্তু দূরদর্শিতার অভাবে তারা খালের উৎসমুখে বাঁধ দেয়, যা পরবর্তীতে ভারতের বাধায় আর সরানো সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় আগে শুকনো মৌসুমে সামান্য যেটুকু পানি আসতো, ২০০৯ সাল থেকে তা আসাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত এ চুক্তি হওয়ায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে দেরিতে হলেও আমরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবো।'

জকিগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. শেখ ফরিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রহিমপুর খাল এবং সংযুক্ত অন্যান্য খালের পাড়ের জমি অত্যন্ত উর্বর এবং এখানে ব্যাপকভাবে আমন ধান চাষ হয়। কিন্তু শুকনো মৌসুমে সেচ সংকটে এই উর্বর ভূমিতে রবিশস্য ফলানো সম্ভব হয় না। রবিশস্য না হওয়ায় উপজেলার শীতকালীন সবজি চাহিদা মেটাতে নির্ভর করতে হয় অন্য এলাকার ওপর।'

তিনি বলেন, 'রহিমপুর খাল দিয়ে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার করার মাধ্যমে শুকনো মৌসুমে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে লক্ষাধিক মানুষ উপকৃত হবে। এছাড়াও এ খালের ভাটিতে থাকা হাওরাঞ্চলেও বোরো চাষাবাদ সম্ভব হবে।'

একই কথা জানান হাসিতো গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক খলিলুর রহমান। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'রহিমপুর খালে পানি না আসায় আমরা আমন চাষ করতে পারলেও বোরো চাষ করত পারি না, একইসঙ্গে রবি মৌসুমে সবজিও চাষ করতে পারি না। এছাড়াও হাওর শুকিয়ে যাওয়ায় মাছও পাওয়া যায় না। শুকনো মৌসুমে খালে পানি থাকলে চাষাবাদ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি হাওরাঞ্চলে মাছও বাড়বে।'

বারগাত্তা গ্রামের আবুল কালাম বলেন, 'যখন খাল শুকিয়ে যায়, তখন পুরো গ্রাম শুকিয়ে যায়। গ্রামের পুকুরেও পানি থাকে না। জকিগঞ্জ একসময় সুপারির জন্য বিখ্যাত হলেও শুকনো মৌসুমে সুপারি গাছও মরে যায়।'

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাম্প হাউস ও খালের উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার পর গত ৬ বছরে খালের অনেকাংশ আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা দ্রুত উন্নয়ন করতে হবে। আশা করছি দ্রুততম সময়ে সকল আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করে বাঁধ অপসারণ ও পাম্প হাউজ চালু করতে পারলে আগামী শুকনো মৌসুমেই এলাকাবাসী উপকৃত হবেন।'

Comments

The Daily Star  | English

July uprising: The wounds that are yet to heal, one year on

This week marks one year since 15-year-old Md Shahin Alam’s life was forever changed -- not by illness or accident, but by a bullet that tore through his left leg during a rally on August 5, 2024.

15h ago