আর নয় কৃচ্ছ্রতাসাধন

‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন ঠিক আছে। তবে আগামীতে যেকোনো বিপদ হতে পারে। তাই আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।’

বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কৃচ্ছ্রতাসাধনের ঘোষণা দেয়। তবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে বিবেচনায় এখন সেই অবস্থান থেকে সরে আসছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল বুধবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠক থেকে বেরিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন ঠিক আছে। তবে আগামীতে যেকোনো বিপদ হতে পারে। তাই আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।'

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যে অবকাঠামো তৈরি করেছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে প্রধানমন্ত্রী দ্রুত জনবল নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

সভায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বাজেট নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, যা মূল বরাদ্দের চেয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ কম।

পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, 'কৃচ্ছ্রতাসাধন এখনো চলছে। কিন্তু অর্থনীতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় আমরা নীতি কিছুটা শিথিল করেছি।'

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থ বিভাগ গত বছরের ৩ জুলাই একটি প্রজ্ঞাপনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কিছু প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে দেয় এবং কিছু প্রকল্পের বরাদ্দ স্থগিত করে।

হাতে নেওয়া প্রকল্পগুলোকে এ, বি ও সি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এ শ্রেণির প্রকল্পগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলবে, বি শ্রেণির প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করা যাবে এবং সি শ্রেণির প্রকল্প স্থগিত রাখা হবে—এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন।

বর্তমানে সি শ্রেণির যেসব প্রকল্প শেষের দিকে রয়েছে, সেগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য তহবিল দেওয়া হচ্ছে।

সত্যজিৎ কর্মকার জানান, যে প্রকল্পগুলো পুরোদমে চলছে সেগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী তহবিল পাচ্ছে। যেগুলো এখন বাস্তবায়নের প্রয়োজন নেই, সেগুলো স্থগিত রাখা হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'অনেক ধুমধাম করে সরকার সার্কুলার দিয়েছে, কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। কৃচ্ছ্রতার ফলে কত টাকা সাশ্রয় হয়েছে সে সম্পর্কে আর কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।'

তিনি বলেন, 'তারা কোন জায়গা থেকে টাকা বাঁচিয়েছে? আমরা সেটা জানতে চাই।'

৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ২১টির সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৩৭টির কমেছে।

সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, 'মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চাহিদা মূল্যায়নের ভিত্তিতেই এটা করা হয়েছে।'

গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা যায় সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া মন্ত্রণালয়-বিভাগের বরাদ্দ কমেছে।

যেমন: স্বাস্থ্যসেবা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি, খাদ্য এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ কমেছে।

আবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ, ধর্ম এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তের বরাদ্দ বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'এর ফলে অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করবে এবং জ্বালানি মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে।'

তিনি বলেন, 'বরং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা দরকার ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে গড়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল মূল্যম্ফীতি, যা বাজেট লক্ষ্যমাত্রার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।'

তিনি আরও বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছে না, তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। আপনি যদি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনেন, তাহলে মানুষ তাদের একই আয় দিয়ে আরও বেশি কিনতে পারবে। যার ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে।'

সামগ্রিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের নিজস্ব তহবিলের বরাদ্দ কমেনি। বরং, বৈদেশিক সহায়তার মাধ্যমে উন্নয়ন কাজের অর্থায়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কমানো হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক তহবিল ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ কমিয়ে ৭৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'প্রকৃত বাস্তবতা কী, এর মাধ্যমে সেটা ফুটে উঠেছে। আমরা কার্যকরভাবে এবং দ্রুতগতিতে বিদেশি তহবিল ব্যবহার করতে পারি না।'

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে বিদেশি তহবিল এমন এক সময়ে এসে কমিয়ে দেওয়া হলো, যখন এই অর্থায়নের ফলে চলমান ডলার সংকট কমতে পারত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, 'বিদেশি তহবিল ব্যবহারে মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা কম। আর সেটা হচ্ছে না প্রকল্প পরিচালকদের অক্ষমতার কারণে।'

তিনি বলেন, 'আমাদের উন্নয়ন অংশীদারদের নিয়ম খুবই কঠোর। তারা বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এবং এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।'

ফলে, বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলো সবসময় দেরি হয়।

তিনি আরও বলেন, 'তবে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিবকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে বসে বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব দিয়েছেন।'

সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, 'বর্তমানে ৫২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা পাইপলাইনে আছে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর ব্যবহার করতে চাই।'

Comments