জঙ্গি ছিনতাই: ১৪ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশ

এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সব ইউনিটকে জানাতে বলা হয়েছে।
Bangladesh Police Logo

ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জঙ্গিদের জন্য আলাদা প্রিজন ভ্যান, অনলাইনে হাজিরা নেওয়া, জেলখানা পরিবর্তন এবং ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগে পদায়নের আগে পুলিশের প্রাক-পরিচয় যাচাইসহ ১৪ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

গত ৩০ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত কমিটির সুপারিশগুলো উল্লেখ করে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে চিঠি দেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন্স) নাসিয়ান ওয়াজেদ।

এই চিঠি মেট্রোর পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের কিছু বিশেষায়িত সেল, কমিশনার, রেঞ্জের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

একইসঙ্গে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সব ইউনিটকে জানাতে বলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, চিঠিটি গত ৩১ আগস্ট প্রাপ্তি স্বীকার করে সিএমপির বিশেষ শাখা থেকে সব বিভাগের ডিসিকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।

সদর দপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ শুরু করেছে সিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগ এবং সিএমপির দক্ষিণ জোন।

তবে চিঠির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানাতে অপারগতা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তারা। এই রেঞ্জের অধীনে ১১টি জেলা রয়েছে।

২০২২ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) দুই সদস্যকে মোটরসাইকেলে করে ছিনিয়ে নেয় অপর জঙ্গিরা। ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গি মঈনুল হাসান শামীম ও আবু সাদিক সোহেল জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি ছিল কি না, বা নিরাপত্তা ত্রুটি খতিয়ে দেখতে সদর দপ্তর একটি উচ্চ সদস্যদের কমিটি গঠন করে।

তদন্ত শেষে ১৪টি সুপারিশ উল্লেখ করে তা বাস্তবায়ন করতে প্রতিবেদন দাখিল করে সেই কমিটি।

সুপারিশে বলা হয়েছে, এটিইউ, সিটিটিসি, এসবি, সিআইডি, যেসব পুলিশ ইউনিট কাউন্টার টেররিজম নিয়ে কাজ করে—এসব ইউনিটের এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। এই সেল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন সংক্রান্তে পুলিশী কার্যক্রম; যেমন: গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অপারেশন, গ্রেপ্তার, তদন্তে সহায়তা, প্রসিকিউশন বিভাগকে সহায়তা ও আসামি পরিবহনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমন্বয় করবে।

জেল কোড ও আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন সাপেক্ষে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ আসামিদের কাশিমপুর কারাগারের পরিবর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ) রাখা যেতে পারে।

এ ছাড়া, ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগে পদায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের প্রাক-পরিচয় যাচাই এবং ত্রৈমাসিক ভেটিং করা যেতে পারে। আসামি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্তে প্রসিকিউশন বিভাগে একটি সফটওয়ার ডেভেলপ করা যেতে পারে।

কারাগারে আসামি প্রবেশের সময় এবং কারাগার থেকে বের করার সময় পুলিশ ও কারারক্ষীদের যৌথ টিম আসামিদের দেহতল্লাশি নিশ্চিত করবে।

শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বন্দিদের বিজ্ঞ আদালতে এবং অন্যত্র স্থানান্তরকালে প্রিজন ভ্যান দিয়ে যথাযথ নিরাপত্তা সঙ্গে পরিবহন করা যেতে পারে। অন্য কোনো গণপরিবহনে এ ধরনের স্পর্শকাতর আসামি পরিবহন করা যাবে না।

প্রতিটি প্রিজন ভ্যানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা যেতে পারে এবং এতে করে প্রিজন ভ্যানের অভ্যন্তরে আসামিদের গতি-প্রকৃতি মনিটরিং করা সম্ভব হবে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিদের স্বতন্ত্র প্রিজন ভ্যানে পরিবহন করা যেতে পারে।

ডিএমপির বিজ্ঞ সিএমএম কোর্টের হাজতখানা ইনচার্জ হিসেবে বর্তমানে একজন সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত। তার পরিবর্তে বিজ্ঞ সিএমএম ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় ইনচার্জ হিসেবে অন্যূন একজন সহকারী পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যেতে পারে। অন্যান্য ইউনিটে হাজতখানা ইনচার্জ হিসেবে এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যেতে পারে। আসামি পরিবহন বা গমনাগমনের জন্য ঢাকার সিজেএম ভবনের উত্তর দিকের সিএমএম হাজতখানা সংলগ্ন গেটটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধনপূর্বক ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাজাপ্রাপ্ত বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ক্ষেত্রে আদালতে অনলাইন হাজিরা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এ ছাড়া, আদালতে আরও সিসি ক্যামেরা স্থাপন, আসামির স্কর্ট দেওয়া এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়, আদালতের ডিউটির আগে উত্তমভাবে ব্রিফিং ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে সুপারিশে।

সিএমপির ডেপুটি কমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সদর দপ্তরের সুপারিশের ভিত্তিতে কিছু অগ্রগতি করেছি আমরা। চট্টগ্রাম কারাগারে থাকা জঙ্গি, হাই প্রোফাইল নিষিদ্ধ জঙ্গিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমাদের দল কাজ শুরু করেছে।'

তিনি বলেন, 'গত বছরের ঘটনার কথা বিবেচনা করে আমরা নিষিদ্ধ বা দণ্ডিত জঙ্গিদের কারাগার থেকে আদালতে যাতায়াতের সময় আদালত ও প্রিজন ভ্যানে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছি। জেল কর্তৃপক্ষ ভার্চুয়াল আদালত বা অনলাইন শুনানির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলতে পারে। কারণ তাদের এখতিয়ার ভুক্ত।'

চট্টগ্রাম উপ-মহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ের এসপি (অপারেশনস) নেসার উদ্দিন আহমেদের কাছে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোনে তা জানতে অস্বীকৃতি জানান।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার মো. মনজুর হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এখন পর্যন্ত পুলিশের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি পাইনি। তবে আমাদের কাছে ভার্চুয়াল কোর্ট করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, যা একটি প্রকল্পের আওতায় কারা কর্তৃপক্ষ নিজেরাই স্থাপন করছে।'

'ভার্চুয়াল কোর্ট চালু আদালতের এখতিয়ার। তবে এটি চালানোর জন্য আমাদের সম্পূর্ণ সেটআপ রয়েছে। যদি এটি সম্পর্কে কোনো আদেশ থাকে, তবে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে তা করতে পারবো,' তিনি যোগ করেন।

পুলিশ ও কারা সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ও দণ্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ৫০ জঙ্গি রয়েছে। কারাগারের বিশেষ সেলে তাদের আলাদাভাবে রাখা হয়। এ ছাড়া, চট্টগ্রাম কারাগারে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির জঙ্গিদেরও রাখা হয়।

 

Comments