রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির সংলাপের সফলতা নিয়ে সংশয়

বিএনপি কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটের ভেতরে রাখা খালি চেয়ারে রাখা ইসির আমন্ত্রণপত্র। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার

নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, তা নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কতটুকু সফল হবে—এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তারা মনে করছেন, আগামীকাল ৪৪টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একদিনের যে আলোচনা হওয়ার কথা, তা 'লোক দেখানো' ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ও তাদের সুপারিশ জানাতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় পাবে।

অন্যদিকে ইসি এমন সময়ে এই উদ্যোগ নিয়েছে, যখন বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে কিংবা পালিয়ে আছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতারা যখন কারাগার বা পালিয়ে আছেন—এমন অবস্থায় ইসি বিএনপিকেও সংলাপের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। অথচ পরিস্থিতি এতই জটিল যে ইসির আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করার মতো লোকও গতকাল দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি।

আবার রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব বা তাদের মনোনীত নেতাদের সঙ্গে এমন সময়ে ইসি এই সংলাপ করছে, যখন নির্বাচনের আর খুব বেশি সময়ও বাকি নেই।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি ও সমমনা দল এই সংলাপে অংশ নেবে না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অজ্ঞাত স্থান থেকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংলাপে কে অংশ নেবে? সবাই (বিএনপি নেতারা) হয় কারাগারে অথবা পলাতক। যদি আপনার হাত-পা বাঁধা থাকে এবং ভালো খাবার পরিবেশন করা হয়, তাহলে আপনি কি খেতে পারবেন? এই নির্বাচন কমিশন কি শেখ হাসিনার নির্দেশের বাইরে যেতে পারবে?'

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে এবং রিজভীসহ অন্যান্য অনেক নেতাই পলাতক আছেন।

গত ২৮ অক্টোবরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

সংলাপের আমন্ত্রণপত্র দেওয়ার জন্য গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়েও কোনো নেতাকে খুঁজে পায়নি ইসি।

আমন্ত্রণপত্র নিয়ে গতকাল সকালে নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান ইসির অফিস সহকারী। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান, তালাবদ্ধ পল্টন কার্যালয়ে কঠোর পুলিশি পাহারা। আমন্ত্রণপত্র দেওয়ার মতো কাউকে না পেয়ে তিনি খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান। সেখানেও কাউকে না পেয়ে বিকেলে নয়াপল্টনে ফিরে বিএনপি কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটের ভেতরে রাখা খালি চেয়ারে চিঠিটি ঝুলিয়ে রেখে চলে যান তিনি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে আমন্ত্রণপত্রটি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি অর্থবহ সংলাপে বিএনপির অংশ নেওয়ার বিষয়টি ইসিকে নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীন ও সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে ইসি সরকারকে বলতে পারে যে, সরকার যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে সংলাপের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করে।

ইসির ঘোষণা অনুযায়ী, আগামীকাল সকাল সাড়ে ১০টায় আওয়ামী লীগসহ ২২ দলের সঙ্গে বৈঠকে বসবে তারা। বিকেল ৩টায় বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ আরও ২২ দলের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, '৪৪টি রাজনৈতিক দলের ৪৪ জন প্রতিনিধি যদি ১০ মিনিট কথা বলেন, তাহলে কত সময় লাগবে? সংলাপের সময় যুক্তিতর্ক ও পাল্টা যুক্তি থাকবে। এত সীমিত সময়ের মধ্যে এতগুলো দলের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ কি সম্ভব?'

এই সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনবে না এবং অর্থবহও হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির সঙ্গে যাতে অর্থবহ সংলাপ নিশ্চিত হয়, সেজন্য ইসিকে উদ্যোগ নিতে হবে উল্লেখ করে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, প্রায় দুই বছর আগে এই ইসি দায়িত্ব গ্রহণ করলেও তারপর থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে তারা কোনো অর্থবহ উদ্যোগ নেয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা নির্বাচন কমিশনের সংলাপের খেলা, সত্যিকারের সংলাপ নয়। এটা শুধুই লোক দেখানো।'

তিনি বলেন, ইসির একার পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব না। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নয়—এমন নির্বাচন ঠেকাতে তারা পারবে।

সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে ইসির ব্যর্থতার সমালোচনাও করেন বদিউল আলম মজুমদার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ডেইলি স্টারকে বলেন, ইসির উদ্যোগ আগের মতো ব্যর্থ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছর ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরির আগেও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আরেক দফা সংলাপ করে কমিশন। দুইবারই বিএনপি সংলাপ বয়কট করে।

চলতি বছরের মার্চেও সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বিএনপিকে অনানুষ্ঠানিক আলাপের জন্য আধা-সরকারি (ডিও) লেটার পাঠায়। কিন্তু বিএনপি তার উত্তর দেয়নি।

বিগত সংলাপের সময় বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি ইসি।

বর্তমানে বিএনপি চাচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ চাচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন। চলমান এই সংকটটি 'রাজনৈতিক' বলে মন্তব্য করে আসছেন সিইসিসহ অন্যান্য ইসিরা। এমন পরিস্থিতিতে এই সংলাপের মাধ্যমে কোনো ধরনের সফলতা আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

5h ago