এমভি আব্দুল্লাহ

‘জলদস্যুরা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেভি সদস্যরা ওঠেন জাহাজে’

মুক্তির দিন সকাল থেকেই দস্যুরা অনেক সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল বলে জানান এমভি আব্দুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান।
চট্টগ্রাম বন্দরে নেমেই দুই মেয়েকে জড়িয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এমভি আব্দুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ। ছবি: স্টার

সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তির এক মাস পর চট্টগ্রাম ফিরেছেন এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিক। 

কুতুবদিয়া থেকে এমভি জাহান মণি-৩ লাইটার জাহাজে করে আজ মঙ্গলবার বিকেলে তারা চট্টগ্রাম বন্দরে আসেন।

বন্দরে তাদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। জাহাজ থেকে নেমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটান তারা। 

জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার দিনের ঘটনা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন এমভি আব্দুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান।

চট্টগ্রাম বন্দরে নামার আগে লাইটার জাহাজে এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক। ছবি: স্টার

তিনি বলেন, 'মুক্তির আড়াই ঘণ্টা আগে জাহাজের ডেকে নিয়ে আমাদের সবাইকে রোদের মধ্যে দাঁড় করায় দস্যুরা। আমরা তখনো বুঝতে না পারলেও আঁচ করতে পেরেছিলাম কী হতে যাচ্ছে। তাদের সবার কাছেই ভারি অস্ত্র ছিল। রকেট লঞ্চার, মর্টার শেল এবং একে-৪৭ জাতীয় ভারি অস্ত্র নিয়ে তারা জাহাজে অবস্থান করেছিল।'

'দাঁড় করানোর পর আমরা দেখতে পেলাম পানিতে কয়েকটি স্পিডবোট ঘুরছে। এরপর কী হয়েছে সেটা তো সবারই জানা,' বলেন তিনি।

'মুক্তির দিন সকাল থেকেই দস্যুরা অনেক সিরিয়াস হয়ে যায়। প্রায় এক মাস তারা আমাদের সঙ্গে নানান সময়ে হাসি-ঠাট্টা-মশকরা করত। কিন্তু সেদিন সকাল থেকেই তারা ছিল অন্যরকম, কথাবার্তাও ছিল ভিন্ন ও কড়া,' বলেন আতিক উল্লাহ।

এই নাবিক আরও বলেন, 'তারা (দস্যুরা) আমাদের বলেছে যে অন্ধকারে রাত ১২টায় নামবে। কিন্তু আশপাশে নেভির জাহাজ দেখে তারা তা করেনি। একপর্যায়ে তারা নেভিকে দূরে সরে যেতে বললেও নেভি তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।'

'শেষে তারা নিজেরাই জাহাজের নোঙ্গর তুলে জাহাজ চালিয়ে কিছু দূরে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে নিরাপদে সরে পড়ে। তারা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাহাজে নেভি সদস্যরা ওঠে,' বলেন তিনি।

মুক্তিপণের বিষয়ে জানতে চাইলে এড়িয়ে গিয়ে আতিক বলেন, 'আমরা তো জাহাজে ছিলাম, কোথায় কী হচ্ছে আমরা দেখতে পারিনি। তারা আমাদের সঙ্গে দোভাষীর সহায়তায় কথা বলত। এক ভালো দোভাষী ছিলেন, তিনিই আমাদের ইংরেজিতে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতেন।'

ঈদের দিন জাহাজের সবার একসঙ্গে ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। ঈদের দিন আমার কাছে থাকা ক্যামেরা দিয়েই সেই দোভাষী ছবি তুলে দেন। কিন্তু ঈদের নামাজের পর বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে তোলা ছবি মিডিয়ায় আসার পর দস্যুদের প্রধান আমার কাছে জানতে চান কীভাবে এই ছবি বাইরে গেল।'

'তখন তারা বুঝতে পারে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। এরপর তারা আমাদের ল্যাপটপসহ অন্যান্য কিছু জব্দ করে রেখে দেয়। তারা ভারি অস্ত্র দিয়ে মাঝে মাঝে সমুদ্রে ফায়ার করত, অস্ত্র ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য। তাই আমরা অনেক উদগ্রীব ছিলাম,' বলেন আতিক উল্লাহ।

জাহাজের অপর নাবিক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন বলেন, 'জাহাজের সেই ৩৩ দিন আমার কাছে ৩৩ বছরের মতো ছিল। দিন শুরু হলে শেষ হতে চাইত না। সবসময় আতঙ্কের মুখে থাকতে হতো। এমনকি ভারি অস্ত্রের মুখেই আমরা নামাজ আদায় করেছি।'

মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর করে কয়লা বোঝাই করে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়ে কেএসআরএম গ্রুপের জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ।

মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত করা হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয় জাহাজটি। 

গতকাল কুতুবদিয়া পৌঁছায় এমভি আব্দুল্লাহ। আজ একটি লাইটার জাহাজে কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে জাহাজের ২৩ নাবিক। 

 

Comments