৪০০ কোটির পিয়ন!

কাঠামো ঠিক থাকলে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থেকেও একজন লোকের দুর্নীতির মাধ্যমে এক লাখ টাকা কামানোরও সুযোগ নেই।

ঝালকাঠি শহরের রাস্তায় সারিন্দা বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে তিলের নাড়ু বিক্রি করতেন অমূল্য দাস। ২০০২ সালে যখন তাকে নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন করি, তখন তিনি বলেছিলেন তার বয়স ৮০ বছর। বেঁচে থাকলে এখন বয়স ১০২। বেঁচে আছেন কি না, জানি না।

সারিন্দা বাজিয়ে তিনি দারুণ সব লোকগান গাইতেন। এর মধ্যে 'ছেলে যায় সাইকেলেতে বাপকে বলে হেঁটে চল' গানের একটি লাইন এরকম: 'একশো টাকার চাকরি করে পাঁচশো টাকার জুতা পায়।'

বহু বছর পরে অমূল্য দাসকে মনে করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে রোববার বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, তার এক সাবেক পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। এই কথা শুনে অমূল্য দাসের ওই গানের লাইন মনে পড়ে গেল।

প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রীর একজন পিয়নের সর্বোচ্চ বেতন কত? তিনি কী করে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হলেন? কোন প্রক্রিয়ায়?

১০০ টাকার চাকরি করে ৫০০ টাকার জুতা পায়ে দেওয়া হয়তো কঠিন কিছু নয়। মাসে মাসে টাকা জমিয়েই সেটা কিনে ফেলা সম্ভব। কিন্তু একজন চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী কী করে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হলেন? এই বিপুল অর্থ বৈধ পথে উপার্জনের কোনো সুযোগ ছিল না। তার মানে তিনি গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে নানা ধরনের তদবির বাণিজ্য করে এই টাকা কামিয়েছেন। নানা ধরনের ব্যবসা করেছেন। হয়তো চাঁদাবাজিও করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ আয়ের অপরাধে তার বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

গণমাধ্যমের খবর বলছে, প্রধানমন্ত্রী তার এক সাবেক ব্যক্তিগত সহকারীকে ইঙ্গিত করে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'আমার বাসায় কাজ করে গেছে পিয়ন, যে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। হ্যাঁ, এটা বাস্তব কথা। তো কী করে বানালো এই টাকা! যখনই আমি জেনেছি তাকে বাদ দিয়ে কার্ড-টার্ড সব সিজ করে আমার ব্যবস্থা আমি নিয়েছি। এটা তো হয়, এটা করে। ধরা পড়লে তো চোখে আসে। তা ছাড়া তো হয় না। যখন ধরা পড়ে তখন ব্যবস্থা নিই।'

প্রশ্ন হলো, এত বড় অপরাধে শুধু তার চাকরিটাই যাবে? তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন বা এখনো কি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই? সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে এই কথা বলেন, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তারা স্বপ্রণোদিত হয়েই এটা করতে পারে।

এরইমধ্যে কোনো কোনো গণমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর ওই সাবেক বক্তিগত সহকারীর নামও প্রকাশ করেছে—যিনি বর্তমান সরকারের টানা চার মেয়াদের প্রথম দুই টার্মের পুরোটা এবং তৃতীয় টার্মের প্রথম কিছুদিন প্রধানমন্ত্রীর পারসোনাল এইড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলে থাকার সময়ও তিনি সুধা সদনে ব্যক্তিগত স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন। যদিও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সরকারের ২০১৮-২৩ মেয়াদের প্রথম দিকে তিনি চাকরিচ্যুত হন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নোয়াখালী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন বলেও শোনা যায়।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নিচের দিক থেকে দুর্নীতি বেশি হয়। এটির বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। সম্প্রতি দুর্নীতি করে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তাদের অনেকেই নিচু পদে চাকরি করতেন। যেমন: গাড়ির ড্রাইভার, ডেসপ্যাচ রাইটার ইত্যাদি। তার অর্থ এই নয় যে, উঁচু পদে দুর্নীতি হয় না। যেমন: বেনজীর আহমেদ পুলিশের সর্বোচ্চ পদেই ছিলেন। পুলিশ বাহিনীর আরও অনেক সিনিয়র অফিসারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা উপার্জনের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। মোশাররফ হোসেন বন বিভাগের বড় পদে ছিলেন। মতিউর রহমান ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য। কাস্টমসের অনেক বড় কর্তার নাম এসেছে।

সুতরাং কে কোন পদে চাকরি করছেন, তার চেয়ে বড় কথা, তিনি মানুষ কেমন, তার পারিবারিক শিক্ষা কেমন, তার মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা কেমন—তার ওপর নির্ভর করে তিনি দুর্নীতি করবেন কি না। একজন নীতিবান লোক সুযোগ পেলেও দুর্নীতি করবেন না। তাতে তিনি গাড়ির ড্রাইভার হোন কিংবা সচিব। আবার যিনি চরিত্রগতভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত, লোভী, নীতিহীন এবং সুযোগ পেয়েছেন বলে হাতছাড়া করতে চান না—এরকম লোক যদি পিয়নও হন, তারপরও তিনি চেষ্টা করবেন কীভাবে ১০ টাকা চুরি করা যায়। এরকম লোক যদি প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকেন, তাহলে তিনি চেষ্টা করবেন কোন প্রকল্প থেকে কত শত কোটি টাকা খেয়ে ফেলা যায়।

বস্তুত একজন পিয়ন বা ঝাড়ুদারের পক্ষে কোনো একটি প্রকল্প থেকে শত কোটি টাকা খেয়ে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু শীর্ষ পদের একজন কর্মকর্তা ফাইল এদিক-ওদিক করে এটা করতে পারেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় বলে শোনা যায়, যেমন: পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইপিডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, গণপূর্ত, রাজউক, ভূমি অফিস—এসব প্রতিষ্ঠানের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রতিটি জেলার পিআইও (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসার) এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসিদের বিরুদ্ধেও শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার কথা শোনা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়াদের তালিকায় তাদের নাম আসেনি। হয়তো আসবে।

একজন সাবেক মন্ত্রী বলেছিলেন, কানাডার বেগমপাড়ায় যেসব বাংলাদেশি বাড়ি কিনেছেন, তাদের বিরাট অংশই সরকারি কর্মকর্তা। বলা হয়, রাজধানীর ঢাকার গুলশান-বারিধারা-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার বিলাশবহুল শত শত ফ্ল্যাটের মালিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, যাদের অধিকাংশেরই বৈধ আয়ে এসব ফ্ল্যাট কেনা অসম্ভব।

সাম্প্রতিক এসব ঘটনাপ্রবাহে অনেকের মনে যে প্রশ্নটি ছিল যে, হঠাৎ করে কেন এভাবে দুর্নীতিবাজদের নাম সামনে আসছে বা কোন পর্যায় পর্যন্ত নাম জানা যাবে কিংবা যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আবেদ আলীর মতো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা শত শত কোটি টাকার মালিক হলেন, শেষ পর্যন্ত তাদের নাম জানা যাবে কি না বা তাদের ধরা হবে কি না? সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সেটিও পরিষ্কার করেছেন যে, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছেন, এটি অব্যাহত থাকবে। 'বড়দের' ধরা হবে বলেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও বঙ্গবন্ধু সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দুর্নীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারও শূন্য সহনশীল নীতির ঘোষণা ছিল। কিন্তু দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। বরং বঙ্গবন্ধুকেই সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেছেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরে দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালুর পর থেকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের প্রত্যেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছে। সবশেষ সেনা নিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর সরকারের সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান হয়েছে। দামি দামি গাড়ি রাস্তায় বেওয়ারিশ পড়েছিল। কিন্তু এতকিছুর পরেও কি দেশে দুর্নীতি কমেছে?

বাংলাদেশ একসময় দুর্নীতির বৈশ্বিক ধারণা সূচকে 'চ্যাম্পিয়ন' হয়েছে। প্রশ্ন হলো, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে এখন বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও দেশের কোথাও কি দুর্নীতি কমেছে? সরকারের কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের কি নাম বলা সম্ভব যেটি শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত?

সরকারের অনেক অফিসে সাইনবোর্ডে লেখা থাকে: 'আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত'। অথচ সেসব প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়েও মানুষকে ঘুষ দিতে হয়। বেনজীর আহমেদের মতো পুলিশ কর্মকর্তাকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়। মতিউর রহমানও নাকি সবাইকে সৎ পথে থাকার উপদেশ দিতেন। আবেদ আলী তো একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেই দিয়েছেন যে, প্রশ্নফাঁস করে যা কামাই করেছেন, তার সব আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছেন। তার মানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, ধরা না পড়ার আগ পর্যন্ত সব শয়তানই ফেরেশতা।

বেনজীর আহমেদের কুকীর্তি ধরা না পড়লে তিনি শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন সৎ, মানবিক ও দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসার হিসেবেই গণ্য হতেন। ধরা না পড়লে আবেদ আলীর এলাকার লোকেরাও জানত না যে, তিনি আসলে কোনো শিল্পপতি নন। বরং তিনি ছিলেন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক এবং প্রশ্নফাঁসের টাকা দিয়েই এত সম্পদ বানিয়েছেন। মসজিদ তৈরি করেছেন। অনেকবার হজে গেছেন। অনেককে হজ ও ওমরায় পাঠিয়েছেন। সুতরাং ধরা না পড়লে আবেদ আলী এবং তার ছেলে এলাকার মানুষের কাছে 'মানবতার ফেরিওয়ালা' হয়েই থাকতেন। হয়তো তিনি জনপ্রতিনিধিও হয়ে যেতেন।

প্রশ্ন হলো, একজন পিয়ন যে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন; একজন ড্রাইভার যে শত শত কোটি টাকা কামাচ্ছেন; এনবিআরের একজন সদস্য, একজন পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের যেকোনো পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী যে এভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন—সেটি কী করে সম্ভব হয়? রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোথাও কি বড় ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে, নাকি কাঠামোটিই ভেঙে পড়েছে?

কাঠামো দুর্বল না হলে কিংবা কাঠামো ভেঙে না পড়লে একজন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পক্ষে শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাঠামো ঠিক থাকলে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থেকেও একজন লোকের দুর্নীতির মাধ্যমে এক লাখ টাকা কামানোরও সুযোগ নেই। কিন্তু এসব বড় বড় চোর ও দুর্নীতিবাজের কাছে এখন লাখ কোনো অঙ্ক নয়। শত কোটির নিচে সম্পদ গড়লে সেটি এখন আর ধর্তব্যের বিষয় নয়। সুতরাং অমূল্য দাসকে এই পরিস্থিতিতে একটা গান বানাতে হলে তিনি 'একশো টাকার চাকরি করে পাঁচশো টাকার জুতা পায়ে'র জায়গায় হয়তো লিখবেন: 'হাজার টাকার চাকরি করে শত কোটির মাল কামায়।'

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments