আলজাজিরার অনুসন্ধান

যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র-দুবাইয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের প্রায় আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

সাইফুজ্জামানকে নিয়ে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আলজাজিরা ছবি: আলজাজিরার ভিডিও থেকে নেওয়া

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র-সংযুক্ত আরব আমিরাতে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। আর এর সবই জানতেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব দেশে সাইফুজ্জামানের ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা আট হাজার ১০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে উঠে এসেছে আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।

বুধবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এই বিরাট সম্রাজ্যের বিস্তারিত তথ্য। এই প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে।

যুক্তরাজ্যে বাড়ি কেনার জন্য সাইফুজ্জামান বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করেছেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি দেশটিতে ২৬৫টি বাড়ি কিনেছিলেন। ২০২২ সালে তিনি সেখানে কিনেছেন ৮৯টি বাড়ি। সবমিলিয়ে যুক্তরাজ্যে তার বাড়ি রয়েছে ৩৬০টি, যার দাম ২৫ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা)।

সাইফুজ্জামান ২০১৪ সালে হাসিনা সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ সালে ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এই পদে তিনি ছিলেন ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত।

প্রতিবেদনে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে তার একটি বিলাসবহুল ও অত্যন্ত নিরাপত্তাবেষ্টিত পাঁচতলা বাড়ি ঘুড়িয়ে দেখাচ্ছেন ছদ্মবেশী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের।

বাড়িটি ঘুড়িয়ে দেখানোর সময় তিনি সেখানে বলছেন, 'এটা আমাদের সিনেমা হল…এটা আমার নতুন রোলস (রয়েস)…।'

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত চারবারের এই সংসদ সদস্য বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর (হাসিনা) খুবই কাছের ও বিশ্বস্ত মানুষ।

সাইফুজ্জামান বলেছেন, 'আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর (হাসিনা) খুব কাছের মানুষ ছিলেন। সত্যি বলতে আমিও। তিনি (হাসিনা) আমার বস।'

ভূমিমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৮ সালের জুনে বাংলাদেশের ইউসিবি ব্যাংক দখল করেন সাইফুজ্জামান। গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ইউসিবির বোর্ড ভেঙে দিলে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি। জব্দ করা হয়েছে বাংলাদেশে তার ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবও।

বিদেশে সম্পদ ক্রয়ের ক্ষেত্রে নানান ব্যবসা থেকে আয় এবং ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সেগুলো কিনছেন বলে দেখিয়েছেন সাইফুজ্জামান। দুবাইয়ে ব্যবসার মাধ্যমে করা আয় যুক্তরাজ্যে নিয়ে সম্পদ কিনছেন, এমনটি দেখানো হলেও বাংলাদেশ থেকেই দুবাইয়ে অর্থপাচার করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে।

এসব সম্পদের কোনো কিছুই সাইফুজ্জামান বাংলাদেশে তার বার্ষিক আয়কর রিটার্ন বা নির্বাচনী হলফনামায় কখনোই উল্লেখ করেননি।

যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের এজেন্ট রিপন মাহমুদ আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জানান, এসব বিনিয়োগ হয় ছোট ছোট অংকে, যাতে সেসব দেশের সরকারের নজরে না পরে যায়।

রিপন বলেন, 'তিনি (সাইফুজ্জামান) এক কোটি (ডলার) আনেন এবং বলেন যে আমি নগদে কিনিনি, ব্যাংক আমাকে টাকা দিয়েছে।'

কেবল যুক্তরাজ্যে নয় যুক্তরাষ্ট্রেও নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট আছে সাইফুজ্জামানের। এর মধ্যে পাঁচটি নিউইয়র্কের প্রধান এলাকাগুলোতে এবং চারটি নিউজার্সিতে।

আলজাজিরাকে রিপন জানিয়েছেন, প্রতি বছর তার মাধ্যমে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন সাইফুজ্জামান। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।

এসব অর্থপাচার এবং বিদেশে বিনিয়োগের জন্য সেসব দেশের ব্যাংক কর্মকর্তা, ফাইন্যান্সার, আইনজীবী, রিয়েল স্টেট কোম্পানি, এজেন্টের সঙ্গে নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন সাইফুজ্জামান।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়েও সাইফুজ্জামানের রয়েছে অঢেল সম্পদ। সেখানে তার ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে রয়েছে প্রচুর সম্পত্তি।

দুবাইয়ে তাদের অন্তত ৫৪টি সম্পত্তি রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের বাড়িতে বসে আলজাজিরার ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দুবাইয়ে তার সম্পদের বর্ণনা দিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, 'আমার সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বাড়ি আছে। নিউইয়র্ক, ম্যানহ্যাটনে আমার সম্পত্তি আছে।'

তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী (হাসিনা) জানতেন যে এসব দেশে তার ব্যবসা রয়েছে।

এ সময় আলাপচারিতায় তিনি জুতা, স্যুটসহ বিলাসবহুল সব পণ্য কিনে থাকেন বলে জানান।

তিন হাজার পাউন্ড বা প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টাকা দামের একেকটি জুতা এবং ছয় হাজার পাউন্ড বা প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকা দামের একেকটি স্যুট তিনি কেনেন বলে জানান।

বাংলাদেশের মুদ্রানীতি অনুযায়ী, দেশের নাগরিকেরা বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারেন না।

বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে এত টাকা নেওয়ার পদ্ধতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, 'আমার দুবাইয়ে একটা ব্যবসা আছে। সেখানে একটা রিয়েল স্টেটে কেনা-বেচার ব্যবসা করি। দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি।'

বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে কীভাবে টাকা আসে সেটা ব্যাখ্যা করে রিপন জানান, দুবাইয়ের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশি কোম্পানির ব্যবসা দেখিয়ে টাকা নেওয়া হয়।

আলজাজিরার ছদ্মবেশী সাংবাদিক চীন থেকে দুবাইয়ে অর্থ নিতে চান জানালে হুন্ডির মাধ্যমে এই লেনদেনে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবেন বলেও জানান সাইফুজ্জামান।

সাইফুজ্জামানের এজেন্ট রিপন একপর্যায়ে আলজাজিরার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নিউইয়র্ক ও সানফ্রানসিসকোতে সাইফুজ্জামানের দুই কোটি ডলারের স্টক রয়েছে। দুবাইয়ে বিনিয়োগ করা আছে সাড়ে ১৯ কোটি ডলার। লন্ডনে বিনিয়োগ করা আছে ৩০ কোটি ডলার।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, রিপনের তথ্য এবং তাদের অনুসন্ধান মতে বিদেশে সাইফুজ্জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন বা ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় আট হাজার ১০০ কোটি টাকা।

এসব বিষয়ে অফিসিয়ালি মন্তব্য জানতে চাইলে সাইফুজ্জামান আলজাজিরার কাছে দাবি করেন, এসব সম্পত্তি তার বৈধ ব্যবসার অর্থ দিয়ে কেনা এবং তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।

Comments

The Daily Star  | English

Scorched at work: Global report revealed dire heat risks for workers

A joint report released by the World Health Organisation (WHO) and the World Meteorological Organisation (WMO) exposed the growing dangers of extreme heat on workers’ health and productivity worldwide.

34m ago