কুড়িগ্রামে স্কুলশিক্ষক গড়ে তুলেছেন ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’

স্কুলশিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলামের গড়ে তোলা সংগ্রহশালা। ছবি: এস দিলীপ রায়

বিখ্যাত লেখক ও কবিদের বই, পুরোনো ম্যাগাজিন ও পত্রিকা সংগ্রহ করে ১০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে 'বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর'। এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে কবি ও লেখকদের ছবিসহ জীবনী। আরও আছে সাহিত্যিকদের লেখা দুর্লভ চিঠি।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের উত্তর বড়ভিটা গ্রামে এই সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন স্কুলশিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম (৫৭)। লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এই সহকারী শিক্ষক নিজেও ভাওয়াইয়া ও আধুনিক গান লেখেন। বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকারদের মধ্যে রয়েছে তার নাম।

সংগ্রহশালাটি ছাড়াও এই স্কুলশিক্ষক নিজের জমিতে গড়ে তুলেছেন একটি পাঠাগার ও একটি সাংস্কৃতিক ক্লাব।

'বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর' বাংলাদেশের দ্বিতীয় 'লেখক জাদুঘর'। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই জাদুঘর চালু করা হয়। দেশের প্রথম লেখক জাদুঘর চালু হয় ২০১১ সালে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে।

কুড়িগ্রামে গড়ে তোলা জাদুঘরটিতে পাঁচটি গ্যালারি জুড়ে রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই শতাধিক প্রয়াত কবি ও লেখকের তথ্য সম্বলিত ছবি। এখানে রয়েছে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত পুরোনো পত্র-পত্রিকা। সংরক্ষণ করা হয়েছে মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সম্পাদিত ১৯৩৬ সালের মাসিক 'মোহাম্মদী' পত্রিকা। কালীশ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৪৫ সালের 'রূপ-মঞ্চ' এবং শ্রী দিলীপ সেন গুপ্ত সম্পাদিত ১৯৫৫ সালের 'সচিত্র ভারতী' পত্রিকা। সিনেমার পত্রিকাও রয়েছে অনেক। ১৯৬০ সালের মার্চ সংখ্যা মাসিক 'মৃদঙ্গ'। ক্ষিতীশ সরকার সম্পাদিত ১৯৬১ সালের 'জলসা' পত্রিকা আছে। আবু জাফর সম্পাদিত ১৯৬৩ সালের 'সন্দেশ' এবং গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ১৯৬৮ সালের 'সচিত্র সন্ধানী' আছে এখানে। ১৯৫৯ সালের সাপ্তাহিক 'পাকিস্তানী খবর' এবং ১৯৫৯ সালের 'পাক-সমাচার' আছে এ জাদুঘরে। ধর্মীয় পত্রিকা মাসিক 'নেয়ামত' এবং ১৯৬১ সালের 'সমকাল' আছে এখানে। ১৯৬৬ সালের 'পূবালী' পত্রিকাসহ 'বেগম' পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা আছে এখানে।  ১৯৬৮ সালের বিমল মিত্র সম্পাদিত 'কালি ও কলম' পত্রিকা আছে। ১৯৬৮ সালের রবীন্দ্র ভারতী পত্রিকা, ১৯৬৯ সালের বিশ্বভারতী পত্রিকা এবং ১৯৭০ সালের কবীর চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি পত্রিকা সংরক্ষণ কেরা হয়েছে এ জাদুঘরে। রেডিও পাকিস্তানের পাক্ষিক পত্রিকা 'এলান' রয়েছে এখানে। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচিত ৭ম ও ৮ম শ্রেণির ব্যাকরণ পরিচয়। সুবলচন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ১০০ বছরের পুরনো 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'। এ ছাড়াও আছে প্রায় একশ বছর আগে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বই। এখানে রয়েছে ১৫০ বছর আগে বঙ্কিম চন্দ্র সম্পাদিত পত্রিকা 'বঙ্গদর্শন' ১১০ বছর আগের প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত 'সবুজপত্র'। এ জাদুঘরে রয়েছে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক 'হক-কথা'। এছাড়া এখানে আছে ১৯৬৫-১৯৭২ সালের বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকা।

স্কুলশিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম ২০২২ সালে 'আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা' পান। সম্মাননার সাথে পাওয়া দুই লাখ টাকায় শুরু করেন জাদুঘর নির্মাণকাজ। নিজের জমানো আরও কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করে গড়ে তোলেন এই সংগ্রহশালা।

এর আগে নিজ খরচে ২০১১ সালে গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম পাঠাগার ও ২০২১ সালে সৈয়দ শামসুল হক সাংস্কৃতিক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। পাঠাগারে রয়েছে ছয় হাজার বই ও পত্র-পত্রিকা। তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে ২০২১ সাল থেকে চালু করেছেন সৈয়দ শামসুল হক শিশুসাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিবছর গুণীজনদের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।

লালমনিরহট থেকে আসা দর্শনার্থী মুহিন সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি বঙ্গভাষা জাদুঘরে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। জাদুঘরটি ঘুরে দেখলে অনেক পুরনো ইতিহাস জানা যাবে।'

স্কুলশিক্ষার্থী একাদশী রানী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা পাঠাগারে বই পড়তে আসলে চকলেট পাই। গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী এই পাঠাগারে বই পড়ে সমৃদ্ধ হচ্ছি। আমরা এখান থেকে বই বাড়িতে নিয়ে যাই। বইপড়া শেষে পাঠাগারে বই ফেরত দেই।'

স্থানীয় সাংবাদিক মহাফুজার রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, জাদুঘরে পুরাতন দুর্লভ পত্র-পত্রিকার মূল কপি সংরক্ষিত আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ জাদুঘরের ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কালচারাল ক্লাবে গ্রামের লোকজন সমবেত হয়ে দেশীয় কালচার চর্চা করার সুযোগ পাচ্ছেন।

জাদুঘর, পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে জমি বিক্রি করেছেন স্কুলশিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম। তার এক ছেলে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে। এক মেয়ে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

তৌহিদ-উল ইসলামের স্ত্রী বেগম আমিনা সুলতানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথমদিকে স্বামীর এসব কাজ পাগলামি বলে মনে হয়েছিল। এখন মনে করছি আমার স্বামী সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববান। সামাজিক কাজ করতে গিয়ে তিনি মাঝে মাঝে পরিবারের কথাই ভুলে যান। আমরা একসময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো কিন্তু আমার স্বামীর কাজ আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে।'

স্কুলশিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিজের উপার্জনের অর্ধেক টাকা জাদুঘর, পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাবের পেছনে ব্যয় হয়েছে। দুর্লভ লেখা ও পত্রিকা সংগ্রহ করতে টাকা খরচ করতে হয়েছে। আমার গড়ে তোলা জাদুঘর, পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাব জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে। এটাই হবে আমার পরম শান্তি।'

Comments

The Daily Star  | English

Jatiya Party central office vandalised, library set on fire in Kakrail

Protesters linked to Gono Odhikar Parishad demand ban on JP, accuse it of siding with Awami League

2h ago