শিশু যৌন নির্যাতনের আশঙ্কাজনক বৃদ্ধিতে শিশু অধিকার সংগঠনগুলোর গভীর উদ্বেগ

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা এমন আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩০৬ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ১৭৫। এই শিশুদের মধ্যে ৪৯ জনের বয়স ছয় বছরের মধ্যে এবং বাকিরা সাত থেকে ১৭ বছর বয়সী। এসব ঘটনার মধ্যে অন্তত ১৫২টির ক্ষেত্রে কোনো মামলা না হওয়ায় এই শিশুরা বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এ ছাড়া, বহু ঘটনা অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, এই ধর্ষণ মামলাগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কমবয়সী।
শুধু মেয়েশিশুই নয়, ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে ৩০ জন ছেলেশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে আসকের তথ্যে উঠে এসেছে। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা এরচেয়ে অনেক বেশি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পারিবারিক ও সামাজিক উভয় পরিবেশেই শিশুরা যে গভীর ঝুঁকির মধ্যে আছে, এই পরিসংখ্যানটি তার স্পট প্রমাণ।
এই পরিস্থিতি উত্তরণে সংস্থা তিনটি অবিলম্বে যেসব উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সেগুলো হলো—
১. আইন প্রয়োগ ও জবাবদিহিতা জোরদার
- শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনা দ্রুত ও সঠিকভাবে তদন্ত করা এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা।
- মামলার অগ্রগতির ওপর কড়া নজরদারির জন্য শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- শিশু সুরক্ষা বিষয়ক সমাজকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ১০৯৮ হেল্পলাইন ও শিশু সুরক্ষা ইউনিটের (সিপিইউ) সেবা আরও শক্তিশালী করা।
- ধর্ষণ মামলার তদন্ত ১৫ দিনের মধ্যে ও বিচার ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার সংশোধিত বিধান কার্যকর করা।
- উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের শিশু কল্যাণ বোর্ডের তদারকি কার্যক্রম আরও জোরদার করা।
২. শিশু-সংবেদনশীল বিচার ব্যবস্থা
- নির্যাতিত শিশুদের মানসিক আঘাত (ট্রমা) কমিয়ে আনতে শিশুবান্ধব আদালত ও আইনগত প্রক্রিয়া তৈরি করা।
- নির্যাতিত শিশু ও তাদের পরিবারকে আইনগত ও মানসিক সহায়তা প্রদান।
৩. কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রতিরোধ ও সুরক্ষা
- সামাজিকভাবে শিশুর মর্যাদাহানি কমিয়ে আনতে সারাদেশে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো; সঙ্গে সঙ্গে শিশু অধিকার রক্ষায় সচেতনতা ও দ্রুত আইনি ব্যবস্থার বিষয়ে উৎসাহিত করা।
- শিশুদের ঝুঁকি আগে থেকে বুঝে ব্যবস্থা নিতে কমিউনিটি-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটিগুলোকে আরও শক্তিশালী করা। কমিটিগুলো ঝুঁকি মোকাবিলা ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করবে।
৪. নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
- স্কুল ও মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়রানির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন।
- গোপনে অভিযোগ করার ব্যবস্থা রাখা এবং নির্যাতনে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. জাতীয় শিশু সুরক্ষা কৌশল প্রণয়ন
আইন প্রয়োগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবা সমন্বিত একটি বিস্তৃত জাতীয় কৌশল তৈরি ও বাস্তবায়ন।
৬. হেল্পলাইন সম্পর্কে সচেতনতা ও ব্যবহার বাড়ানো
শিশু নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগ যেন জাতীয় হেল্পলাইন ৯৯৯ ও ১০৯৮-তে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়, সেই বিষয়ে জনসচেতনতা ও আস্থা বৃদ্ধি।
৭. দায়িত্বশীল গণমাধ্যম
- ধর্ষণের ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের সময় ভুক্তভোগীর সামাজিক মর্যাদাহানি এড়াতে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা।
- এ সংক্রান্ত বিচার ও শাস্তির সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে অপরাধীদের জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনে জোর দেওয়া।
যৌথ বিবৃতিতে সই করেছেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সেনগুপ্ত এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, 'শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা একটি জাতীয় সংকট। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে বহুমুখী একটি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যৌন নির্যাতনের পরিসংখ্যানে থাকা প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার একজন শিশু ও তার পরিবার, যারা ক্রমাগত সামাজিক মর্যাদাহানি, মানসিক আঘাত ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এসব ঘটনা অপ্রকাশিত বা অমীমাংসিত থেকে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা।'
এতে আরও বলা হয়, 'বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শিশুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ওপর। নিরাপদ পরিবেশের অভাবে শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের জীবনে একটি স্থায়ী ক্ষত জায়গা করে নেয়। শিশুদের সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এটি আমাদের নৈতিক, আইনগত ও জাতীয় দায়িত্ব।'
Comments