সিলেট সিটি নির্বাচন

‘বহিরাগত’ আনোয়ারুজ্জামানে আওয়ামী লীগে অন্তর্কোন্দলের আশঙ্কা

দলীয় নেতাকর্মীদের আশঙ্কা, দীর্ঘদিন ধরে মনোনয়নের প্রত্যাশায় থাকা বেশ কয়েকজন নেতা মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় আগামী নির্বাচনে আনোয়ারুজ্জামানের বিরুদ্ধে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে আসন্ন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্তে সিলেট মহানগরের তৃণমূল রাজনীতিতে অন্তর্কোন্দল সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

দলীয় নেতাকর্মীদের আশঙ্কা, দীর্ঘদিন ধরে মনোনয়নের প্রত্যাশায় থাকা বেশ কয়েকজন নেতা মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় আগামী নির্বাচনে আনোয়ারুজ্জামানের বিরুদ্ধে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।

কিংবা দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের একটি বড় অংশ ও তাদের অনুসারীরা বর্তমান মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীকে গোপনে সমর্থন জানাতে পারেন বলে দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপি সরাসরি নির্বাচনে না আসায় আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচনে অংশগ্রহণ এখনো অনিশ্চিত। তবে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের অনুমতি নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদি তিনি (আনোয়ারুজ্জামান) সিলেট শহরের একজন বহিরাগত হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে তা হবে সিলেটের তৃণমূল রাজনীতির অবসান।'

সিলেট পৌরসভা ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। তখন থেকে ২০১৮ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৪টি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।

৪ বারের মধ্যে প্রথম ২ মেয়াদে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তারপর ২০১৩ ও ২০১৮ সালে ২ বার বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা গোপনে কামরানের বিপক্ষে কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০২০ সালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কামরান। তখন থেকেই ২০২৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে তোড়জোড় শুরু করেন বেশ কয়েকজন নেতা।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রার্থীরা হলেন—আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট মহানগর শাখার সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন।

এ ছাড়াও, মহানগর শাখার যুগ্ম সম্পাদক এটিএমএ হাসান জেবুল, যুগ্ম সম্পাদক ও সিলেট সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ এবং কামরানের ছেলে ও মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান আহমদ ‍শিপলুও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।

চলতি বছর যখন সিটি নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসে, তখন গত ২২ জানুয়ারি দেশে ফেরেন আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি দাবি করেন, সিলেট সিটি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তির বিষয়ে দলের উচ্চপর্যায় থেকে তিনি 'বিশেষ বার্তা' পেয়েছেন।

পরবর্তীতে অনেক জল্পনা-কল্পনার পর চলতি মাসে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করলে মনোনয়নপত্র কিনেন ১১ জন নেতা। বাছাই শেষ গত শনিবার আনোয়ারুজ্জামানকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড।

সিলেট নগরীর রাজনীতির সঙ্গে আনোয়ারুজ্জামানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ব্যবসায়ী এবং সেখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও দেশে দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও তিনি সখ্যতা বজায় রেখেছেন।

বিগত ২ জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-২ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন আনোয়ারুজ্জামান। কিন্তু এই আসনেরই সাবেক সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীও মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকায় আসনটি ২ বারই জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ।

উল্লেখ্য, শফিকুর রহমান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ব্যবসা রয়েছে এবং তিনিও সেখানে দলীয় উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখেন।

আনোয়ারুজ্জামানকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়ে সিলেট-২ আসন নিয়ে আনোয়ারুজ্জামান ও শফিকুরের কোন্দলের সমাপ্তি হলেও সিলেট নগরে আওয়ামী লীগের মধ্যে নতুন করে সংঘাত ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির একাধিক নেতা।

এদিকে ১৪ দিনের লন্ডন সফর ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে রোববার সিলেটে ফিরে আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন, তার দল বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে তিনি নাগরিকদের ইচ্ছাকে সম্মান জানাবেন।

বিএনপির একাধিক নেতার ভাষ্য, আরিফুল লন্ডনে তারেক রহমানের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি দিয়ে দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, আরিফুল নির্বাচন করলে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের গোপন সমর্থন পাবেন। আর তিনি নির্বাচন না করলে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী দেখতে পারে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিটি সিদ্ধান্তেরই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক দল এবং দল যখন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার বিরুদ্ধে বলার কিছু থাকে না। আমরা দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করেছি।'

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে আরও কয়েকজন প্রার্থীও একই কথা বলেন এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার পক্ষে কাজ করবেন বলেও তারা জানান।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর সোমবার বিকেলে ঢাকা থেকে সিলেট বিমানবন্দরে অবতরণ করেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।

সে সময় সিলেট মহানগর শাখার বেশ কিছু নেতা আনোয়ারুজ্জামানকে বরণ করতে বিমানবন্দরে গেলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী বাকি ১০ নেতার মধ্যে মাত্র ২ জনকে বিমানবন্দরে দেখা যায়।

তারা হলেন—সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ২ সাংগঠনিক সম্পাদক ছালেহ আহমদ সেলিম ও আরমান আহমদ শিপলু। বাকিদের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ প্রবাসে অবস্থান করছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

বিমানবন্দরে অবতরণের পর আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর কাছে মনোনয়নবঞ্চিত তৃণমূলের মধ্যে অসন্তোষের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল এবং সে কারণেই অনেকেই প্রার্থী ছিলেন। তবে তারা সবাই আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং আমার সঙ্গে ইতিবাচক কথা বলেছেন। আমি সবাইকে যুক্ত করে কাজ করতে চাই।'

Comments