ভোট-জোটের রাজনীতি নাকি গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়ার ইশারা

ভোটকে কেন্দ্র করে আনকোরা-নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এবার স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে ব্যাপক, প্রাণক্ষয়ী ও রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, সেখানেও নির্বাচন সামনে রেখে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সব দল।
সেইসঙ্গে দেশে নির্বাচন ঠিক কবে হবে সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো কোনো রোডম্যাপ না দিলেও নানা মেরুকরণ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। বিএনপি-জামায়াতের মতো পুরনো দলের পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারির সংগঠকদের নিয়ে গঠিত নতুন দল এনসিপিও ছোট ছোট দলগুলোকে নিয়ে আলাদা বলয় তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর গত সাড়ে আট মাসে এনসিপিসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্ত হওয়া মোট দলের সংখ্যা ২৪টি। এর সঙ্গে আছে চারটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে তিনটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে এ সময়কালে।
২৬ এপ্রিল এই তালিকায় যুক্ত হওয়া সর্বশেষ রাজনৈতিক দলটি হচ্ছে 'বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি'।
প্রশ্ন হলো—এত অল্প সময়ে এতগুলো দলের জন্ম কি কেবল আগের ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা? নাকি গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী 'নতুন আকাঙ্ক্ষার' বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়ার ইঙ্গিত?
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ এবং আলতাফ পারভেজ- এর সঙ্গে।

এ ব্যাপারে মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য হলো, ভোট আর জোটের রাজনীতিতে নতুন দল 'গজিয়ে ওঠার' জন্য মুক্ত পরিবেশের দরকার হয় না। সব পরিবেশেই এ ধরনের দলের জন্ম হতে দেখেছে বাংলাদেশ।
আর আলতাফ পারভেজ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখার কথা জানিয়েছেন। কথা বলেছেন নির্বাচন কমিশন আইনের সংস্কার নিয়ে।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে আত্মপ্রকাশ করেছে ১১টি দল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দল এসেছে সেপ্টেম্বরে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশের (এনপিবি)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গত বছরের ২৩ আগস্ট দলটির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এরপর ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ১৯ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, ২০ সেপ্টেম্বর সমতা পার্টি, ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), ২৭ সেপ্টেম্বর সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি) ও ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
চলতি বছরে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত আরও ১৩টি নতুন রাজনৈতিক দল এসেছে। এর মধ্যে গত ২৮ জানুয়ারি এক দিনেই দুটি দলের আবির্ভাব ঘটে—আমজনতার দল ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি। এর আগে ৪ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে দেশ জনতা পার্টি।
ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করে তিনটি দল—বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
নির্বাচন যখন কাছাকাছি চলে আসে, গন্ধ নাকে যায়, তখন দেখা যায় যে বিভিন্ন ব্যক্তি দু-চারজনকে নিয়ে সাইনবোর্ড দিয়ে একটা দল বানিয়ে ফেলে। এরপর তারা অনেকগুলো ছোট ছোট দল নিয়ে বা কোনো একটা বড় দলের সঙ্গে জোট বাঁধে—কোনো সুযোগ-সুবিধা, উচ্ছিষ্ট যদি পায়, তাতেই তারা সন্তুষ্ট। এ কারণেই নির্বাচনের আগে এমন প্রবণতা আমরা দেখি।
মার্চে জন্ম জনতার বাংলাদেশ পার্টি ও জনতার দলের।
চলতি মাসের ১১ এপ্রিল গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ১৩ এপ্রিল ভাসানী জনশক্তি পার্টি, ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) এবং ২৫ এপ্রিল জনতা পার্টি বাংলাদেশ প্রকাশ্যে আসে। ২৬ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি।
এ ব্যাপারে লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এখানে সুযোগ থাকলে বা ইচ্ছে হলে ১৭ কোটি মানুষ ১৭ কোটি দল বানাতে পারে। অবস্থাটা এরকমই।
'নির্বাচন যখন কাছাকাছি চলে আসে, গন্ধ নাকে যায়, তখন দেখা যায় যে বিভিন্ন ব্যক্তি দু-চারজনকে নিয়ে সাইনবোর্ড দিয়ে একটা দল বানিয়ে ফেলে। এরপর তারা অনেকগুলো ছোট ছোট দল নিয়ে বা কোনো একটা বড় দলের সঙ্গে জোট বাঁধে—কোনো সুযোগ-সুবিধা, উচ্ছিষ্ট যদি পায়, তাতেই তারা সন্তুষ্ট। এ কারণেই নির্বাচনের আগে এমন প্রবণতা আমরা দেখি। নির্বাচনের পর আবার তারা হারিয়ে যায়।'
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এবারও সেই একইচিত্র দেখা যাবে বলে ধারণা এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের। তিনি বলেন, 'এবারেরটাও আমরা একইভাবে দেখব। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যারা এসেছে তারা যে নতুন দলটি করেছে, তার বাইরে যে দলগুলো আছে তার সবগুলোর নামও তো জানি না। যেহেতু নির্বাচন কমিশন নিবন্ধনের সময় বাড়িয়েছে, তাতে এটা নিয়ে নানান রকমের তামাশা আমরা দেখব। দেখব কার সঙ্গে কে জুটে যায়।'
অতীতে নির্বাচনের আগে শতাধিক দল নিয়ে জোট গড়ার উদাহরণ তুলে ধরে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, '২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়েও মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টি তথাকথিত ইসলামী দলগুলো নিয়ে একটা বিশাল জোট করেছিল।'

এদিকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদনের সময় ২২ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ ৪৬টি দল সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে। আর এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নতুন আবেদন পড়েছে অন্তত ৬৫টি।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখার কথা জানিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, 'আমি এটা পজিটিভলিই দেখব। নির্বাচন কমিশনের কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে। এর ভেতর কিছু অটোক্রেটিক ব্যাপারও আছে। যেমন: রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের মতো দল গত দুই বছরেও নিবন্ধন পায়নি। এরা পুরনো দল। গণঅভ্যুত্থানে এদের ভালো ভূমিকাও ছিল। এমন আরও অনেক দল আছে যারা (নিবন্ধন) পায়নি। গণসংহতি আন্দোলন ১০ বছর ফাইট করে এবার (নিবন্ধন) পেল। ফলে আমাদের নির্বাচন কমিশনের মধ্যেই অনেক সমস্যা ছিল এত বছর।'
আলতাফ পারভেজ আরও বলেন, 'এখন নতুন করে আবেদন হয়তো অনেক বেশি মনে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন এদের ভেতর থেকে বাছাই করে যারা প্রকৃত অর্থেই সম্ভাবনাময়, সাংগঠনিক ভিত্তি আছে তাদের নিবন্ধন দিতে পারে।'
সমস্যার গোড়াটা আসলে নির্বাচন কমিশনেই। ভারতে যেমন আছে যে ১৩ শতাংশ ভোট পেলে সেই দল জাতীয় দলের স্বীকৃতি পায়, আঞ্চলিক দলের স্বীকৃতি পায়। সেরকম এখানেও কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকুক। বাজে ক্রাইটেরিয়াগুলো আবার বন্ধ করা উচিত।
এই লেখক-গবেষকের পরামর্শ, 'আবার প্রতি নির্বাচনের পর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কিছু বাতিলও করা উচিত। যেমন: একটা নিয়ম হতে পারে, এক শতাংশ কিংবা দশমিক পাঁচ শতাংশ ভোট না পেলে তাদের নিবন্ধন থাকবে না। এতে নতুনরা যেমন আসবে, পুরনো অযোগ্যরা বাদও পড়বে। গত আমলে কিন্তু অনেক ফালতু ফালতু দলকেও রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে শাসকদলের সমর্থনে। ওগুলোও একটু কমানো উচিত।'
আলতাফ পারভেজের পর্যবেক্ষণ, 'সমস্যার গোড়াটা আসলে নির্বাচন কমিশনেই। ভারতে যেমন আছে যে ১৩ শতাংশ ভোট পেলে সেই দল জাতীয় দলের স্বীকৃতি পায়, আঞ্চলিক দলের স্বীকৃতি পায়। সেরকম এখানেও কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকুক। বাজে ক্রাইটেরিয়াগুলো আবার বন্ধ করা উচিত।
'যেমন, বর্তমান নিয়মে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাবে না। যেহেতু তারা আঞ্চলিক। মাত্র তিনটা জেলায় তাদের কার্যক্রম আছে। এটা বদলানো উচিত। ওদের বাকি ৬৪ জেলায় সংগঠন বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, তারা পাহাড়িদের দল। তাদের জন্য আলাদা একটা নিয়ম থাকা উচিত।'
এভাবে নির্বাচন কমিশন আইনেরই অনেক সংস্কার দরকার বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। বলেন, 'অতীতের অভিজ্ঞতা হলো, শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা যেন না হয়।'
লেখক মহিউদ্দিন আহমদও বলেন, 'নির্বাচন কমিশন যদি চায় নির্বাচনের নামে কেউ দল বানিয়ে যেন ফাজলামো করতে না পারে, তাহলে তারা সেটা করতে পারবে।'
৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের এক মাসের মাথায় বিদায় নেন তৎকালীন ইসি। বিদ্যমান আইনের আলোকে এ এম এম নাসির উদ্দিন কমিশন গঠিত হয় ২১ নভেম্বর।
বর্তমান ইসির অধীনেই হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ বছরের ডিসেম্বরে ভোট করার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছেন তারা। আর অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে আসছেন।

নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে বিদ্যমান আইন-বিধি অনুযায়ী ১০টি তথ্য আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। নিবন্ধন ফি হিসেবে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা, যা অফেরতযোগ্য।
দলীয় প্যাডে দরখাস্তের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনি ইশতেহার (যদি থাকে), দলের বিধিমালা (যদি থাকে), দলের লোগো ও দলীয় পতাকার ছবি, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যের নামের তালিকা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সর্বশেষ স্থিতি, তহবিলের উৎস, দল নিবন্ধনের আবেদনকারীর ক্ষমতাপত্র, নিবন্ধন ফি বাবদ অফেরতযোগ্য ট্রেজারি চালানের কপি জমা দিতে হয়।
পাশাপাশি নিবন্ধনের তিনটি শর্তের মধ্যে যেকোনো একটি পূরণের প্রমাণ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। শর্তগুলো হলো—স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনি প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসনে জয়ী হওয়ার রেকর্ড থাকতে হবে, যেকোনো একটি আসনে দলীয় প্রার্থীকে মোট প্রদত্ত ভোটের পাঁচ শতাংশ পেতে হবে এবং কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয়, অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে।
এখন ইসিতে নিবন্ধিত দল আছে ৫০টি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও ৯৩টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর বেশিরভাগই ছিল নামসর্বস্ব। প্রাথমিক কাগজপত্র বাছাইয়েই বাদ পড়েছিল ৮১টি আবেদন।
Comments