বিতর্কিত তিন জাতীয় নির্বাচনে দায়ী কারা?

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আছে তুমুল সমালোচনা ও বিতর্ক। এসব নির্বাচন একতরফা এবং এগুলোর পর অনিয়মের মাধ্যমে সরকার গঠন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, এই তিনটি নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে, হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, যা আমাদের দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্র হুমকিতে পড়েছে বলে অনেকের মত।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র বেশকিছু রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিজেদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ, যা পৃথিবীতে নজিরবিহীন ঘটনা। সেই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে প্রার্থী করে, যাতে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বোঝানো যায়। কোথাও বউ, কোথাও ভাইকে প্রার্থী করা হয়। আবার কিছু আসনে জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য ছোট দলের কাউকে প্রার্থী করা হয়েছে এবং এসব প্রার্থীর নির্বাচনের ব্যয় আওয়ামী লীগের প্রার্থী বহন করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
তবে সেই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যেসব স্থানে শক্তিশালী ছিল, সেখানে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। বিএনপিসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল এই দুটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে অবশ্য ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর কোনো প্রশ্ন নেই।
আর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। একতরফাভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। অভিযোগ আছে, এই নির্বাচনে বিপুল কারচুপি হয়েছে, নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট ভরে রাখা হয় বক্সে।
অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, যেহেতু একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলসহ তাদের সমমনা বেশকিছু রাজনৈতিক দল ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তাই এই দুটি নির্বাচন একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ করলেও এখানে অনিয়মের কিছু নেই। কেননা মাঠে যোগ্য প্রতিপক্ষ ছিল না। তবে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এই দুটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ভিন্ন মাত্রার অনিয়ম আছে বলে মনে করি। এই দুইটি জাতীয় নির্বাচনে যেসব আসনে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল, সেখানে অগ্রহণযোগ্য ও আচরণবিধি পরিপন্থী প্রতিযোগিতার অভিযোগ ছিল, যা কোনো একজন প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য যথেষ্ট। এসব নির্বাচন নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।
এদিকে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেসময় নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে কারচুপির গুরুতর অভিযোগ আছে, যার তদন্ত হওয়া উচিত অবশ্যই। প্রশ্ন হচ্ছে—এসব নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে কারা জড়িত? ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় কি শুধু নির্বাচনে অনিয়ম হয়? গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমার ঠিক এমনটি মনে হয় না। নির্বাচনের সময় একটি অনৈতিক নির্দেশনা উপর থেকে আসতে পারে বা নিচ থেকে কর্মকর্তাদের আনুগত্যের বিষয়ও থাকে। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে এসবের বাইরেও নির্বাচনে অনিয়ম হয় বিভিন্ন পর্যায় থেকে, যেখানে প্রার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে কর্মকর্তাদের 'ম্যানেজ' করে নেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে বিভিন্ন মহল থেকে বিতর্কিত সবশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তদন্তের দাবি আরও জোরালো হয়। দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। পত্রিকার খবর বলছে, এরইমধ্যে এসব নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ২২ জন জেলা প্রশাসককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, বেশ কয়েকজনকে ওএসডিও করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে, শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের বিচারের আওতায় আনলেই কি নির্বাচনী অনিয়মের বিচার সম্পন্ন হবে?
তিনটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনিয়মের ধরণে ভিন্নতা আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ এককভাবে করে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ব্যর্থতা আছে রাজনৈতিক ঐকমত্য আনতে না পারার, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সরকারের ভূমিকা সংকট নিরসনে কতটা আন্তরিক ছিল তা দেখা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশনের কোনো দলকে ভোটে আনার দায়িত্ব না থাকলেও কমিশন সংকট নিরসনে তাদের সর্বোচ্চটুকু করেছে কি না সব দলকে নির্বাচনে আনতে, তা দেখতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলে যেসব বিচারক রায় দিয়েছিলেন, তাদেরও দায় আছে এমন পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকায় আস্থার ঘাটতি ছিল।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও এরকমভাবে খুঁজে দেখতে হবে কার কী ভূমিকা ছিল। এই নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি তেমন না থাকলেও ভোটের দিন বিকেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, ভোট পড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। ভোটের এই হার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। যদি এই সন্দেহ সত্য হয়, তাহলে তা আরও ভয়াবহ। কারণ এবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভোট কারচুপি করতে দেখা যায়নি। তাহলে সন্দেহের তীর প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারদের দিকে যায়। একটি ভোট কক্ষে এই কর্মকর্তারা দায়িত্বপালন করেন। অনিয়ম করলে তাদের সঙ্গে প্রার্থীর এজেন্টদের সহায়তা বা সম্মতিও থাকবে। লাখো নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা ডুবেছে সেটাই ইঙ্গিত করে এবং একটি অনিশ্চয়তার পথ দেখায়।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আছে। অনেকেই বলেন, রাতের ভোটের দায় এড়াতে পারবে না কে এম নুরুল হুদার নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় একটি সংসদীয় আসনের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি রিটার্নিং অফিসার। কিন্তু অনিয়ম কি শুধুমাত্র তার কথায় হয়? নির্বাচনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন পুলিশ সুপার, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইউএনও, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্য, আনসারের কর্মকর্তা ও সদস্য, প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা। এছাড়া কাগজপত্রে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্বে সরাসরি না থাকলেও নির্বাচনে ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করার বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেন তারা। মেট্রোপলিটন এলাকার কিছু আসনে তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাও হন।
নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কমিশন সচিব ও অতিরিক্ত সচিব, ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারেন চাইলে। বিশেষ করে নির্বাচনী অভিযোগের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করলে কোনো অভিযোগেরই সুরাহা হয় না। ফলে ভুক্তভোগী হন হাজারো প্রার্থী। নির্বাচন কমিশন থেকে অনেক অভিযোগ আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেওয়া হয় ব্যবস্থা না নিয়ে। এসব অভিযোগে আছে নির্যাতন, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও বহু রক্তঝরার গল্প। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা প্রধান দায়িত্বে থাকেন। এসব নির্বাচনে অনিয়মের সব দায় তাদেরই নিতে হবে। কেননা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হওয়া অনিয়মের ধারাবাহিকতাই থাকে জাতীয় নির্বাচনে থাকে।
অর্থাৎ তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ও বিতর্কিত হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। সব নির্বাচনে সবখানে অনিয়ম হয়েছে তা নয়। তবে যেসব স্থানে অনিয়ম হয়েছে, সেখানে এই পক্ষগুলোর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মতি ছাড়া অনিয়ম সম্ভব নয়। তাই শুধু ডিসি-এসপি নয়, নির্বাচনী অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো নির্বাচনব্যবস্থা সঠিক পথে আনা তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরবে না ভোটে। দায়ী ব্যক্তিরাই আগামীতে নির্বাচন করবে এবং সুযোগ পেলেই তারা পুরোনো চেহারায় ফিরে যাবে। সংশ্লিষ্টদের বলব তদন্ত করুন, ব্যবস্থা নিন দায়ী সবার বিরুদ্ধে।
কাজী ফরিদ আহমদ: সাংবাদিক
Comments