নির্বাচনের নতুন সময়: আশাবাদী বিএনপি, প্রক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ জামায়াত-এনসিপি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনের জন্য নতুন যে সময় দিয়েছে, তা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন আশাবাদের সৃষ্টি করেছে, তেমনি জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের।

বিএনপিসহ বেশকিছু দল আগামী বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সম্ভব্য নির্বাচনের সময়কে স্বাগত জানালেও কেবলমাত্র একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। নির্বাচন নিয়ে কোনো রোডম্যাপ না দেওয়ায় তারা নিয়মিত অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাও করছিল।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দেন, নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হবে। এরপরই ডিসেম্বরের নির্বাচন আয়োজনের দাবি আরও জোরালো করে বিএনপি।

তবে, ১৩ জুন লন্ডনে ড. ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে হওয়া বৈঠক ও তার ফলাফল এখন দুইপক্ষের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

দলীয় অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলোর মতে, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক শক্তির পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

নির্বাচনের জন্য প্রস্তাবিত নতুন সময় নিয়ে বিএনপি সন্তুষ্ট হলেও সেখানে কিছু শর্ত থাকায় দলটি কিছু উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়েছে।

অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনের এই নতুন সময় নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছে।

জামায়াত গতকাল শনিবার বলেছে, কেবল একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের পর বিদেশে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করা ও বৈঠক নিয়ে যৌথ বিবৃতি দেওয়া 'নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য'।

বিবৃতিতে দলটি বলেছে, এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করেছে।

তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ২০২৬ সালের রমজানের আগের সপ্তাহেই আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এপ্রিলের আগে নির্বাচন করতে হলে সংস্কার ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচারে যথেষ্ট পরিমাণ অগ্রগতি জরুরি।

রমজানের আগে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন তারেক রহমান। তখনই ড. ইউনূস এ মন্তব্য করেন।

রমজান শুরু হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে।

তাদের এই আলাপন নির্বাচনের সময় নিয়ে উভয়পক্ষের অবস্থানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

জামায়াত এ বিষয়ে গতকাল সকালে তাদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে আলোচনা করে।

বিবৃতিতে দলটি বলেছে, একক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার যৌথ সংবাদ সম্মেলন জনগণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে আসন্ন নির্বাচন আদৌ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা।

তারা আরও জানায়, যেখানে বহু রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, সেখানে কেবল একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে সামগ্রিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক নয়।

তারা বলেছে, আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ থাকবে; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে এবং বিচার ও সংস্কার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

এনসিপি ১৩ জুন বিবৃতিতে বলেছে, নির্বাচন ইস্যুতে সরকার একটি নির্দিষ্ট দলের দাবিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বৈঠকে নির্বাচনের সময় নিয়ে আলোচনা হলেও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের জনগণের মূল দাবি—বিচার ও সংস্কার—তেমন গুরুত্ব পায়নি।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি একে অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিসেম্বর থেকে জুন—এই সময়ের মধ্যে যেকোনো তারিখে নির্বাচনে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে তার আগে মৌলিক সংস্কার এবং তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি সমতাভিত্তিক মাঠ নিশ্চিত করতে বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।'

তিনি বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, সংস্কার ও চলমান বিচারে অগ্রগতি হলে ফেব্রুয়ারিতেও নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু বিএনপি যেভাবে প্রচার করছে তাতে মনে হচ্ছে, সরকার নির্বাচনের সময় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে।'

মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ গতকাল এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

দলটি বলছে, নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের দায়িত্ব হচ্ছে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করা। কিন্তু, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দেওয়া তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৈষম্যের বার্তা দেয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব আগামী দিনগুলোতে আরও সতর্ক ও ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, যাতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত হয়।

খেলাফত মজলিশ আরও বলেছে, চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করা এবং গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে যেকোনো গঠনমূলক সংলাপ ও আলোচনা তারা স্বাগত জানায়।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এই বৈঠককে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের পথে একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

রাজধানীতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, 'এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে সহায়ক হতে পারে। সেইসঙ্গে, সরকার কোনো একটি নির্দিষ্ট দিকে ঝুঁকে পড়ছে—এই উদ্বেগও কিছুটা কমতে পারে।'

জামায়াতের বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতের বিষয় নয়। বরং প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত নির্বাচনের নতুন সময় জামায়াত আমিরের প্রস্তাবের সঙ্গেই মিলে যায়। তিনি বলেছিলেন, ২০২৬ সালের রমজানের আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।'

তিনি বলেন, 'কেবল বিএনপি নয়, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই চেয়েছিল নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হোক। রমজান, পরীক্ষা ও আবহাওয়ার দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত। আমরা এই সময়কে স্বাগত জানাই।'

এনসিপির প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, 'এনসিপি বিষয়টিকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। তাদের উচিত দলীয় ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'এই বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচনী অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে আপোষমূলক অগ্রগতির কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।'

তিনি একে সামগ্রিকভাবে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আগামী দিনে রাজনীতি কেন্দ্রীভূত হবে নির্বাচনকে ঘিরে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের হিসাব-নিকাশ করবে, কৌশলগত বিবৃতি দেবে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারে নামবে।'

তিনি বলেন, 'যদি সব দল একমত হতো, তাহলে কোনো দ্বন্দ্ব থাকত না। কিন্তু রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মতপার্থক্য অনিবার্য এবং সেটা স্বীকার করে নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।'

Comments

The Daily Star  | English
bad loans rise in Bangladesh 2025

Bad loans hit record Tk 420,335 crore

It rose 131% year-on-year as of March of 2025

3h ago