ইরান-সৌদি চুক্তি

মধ্যপ্রাচ্যে তাৎপর্য কী

বেইজিং এ চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট দলের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই, ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব আলি শামখানি ও সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাআদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান বৈঠক করেন। ছবি: রয়টার্স
বেইজিং এ চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট দলের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই, ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব আলি শামখানি ও সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাআদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান বৈঠক করেন। ছবি: রয়টার্স

চীনের বেইজিং শহরে অবসান হল সৌদি আরব ও ইরানের দীর্ঘদিনের বৈরিতার। শুক্রবার চীনের মধ্যস্থতায় এই ২ দেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনঃস্থাপনের ঘোষণা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিশ্লেষকরা একে অন্ধকার যুগের অবসান হয়ে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে অভিহিত করছেন।

গতকাল শনিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এই ঘোষণা বিস্ময়কর হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। আঞ্চলিক শক্তিধর এই ২ রাষ্ট্র প্রায় ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছিল। ২ দেশের মাঝে ভরসা ও আস্থার অভাবে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের আলোচনা ফলপ্রসূ হলেও একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের ২০১৬ সালের পারমাণবিক চুক্তির পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনা ব্যর্থতার দিকে আগাচ্ছে। এই ২ আলোচনার মাঝে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব একই ধরনের বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করে থাকে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টানাপড়েন দেখা দিলেও, চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মাঝে থাকা বৈরি সম্পর্ক সত্ত্বেও চীন তাদের সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখিয়েছে। পশ্চিমের দেশগুলোর মতো মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন নিয়ে বড় বড় শর্ত না দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিয়েছে চীন।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইন্সটিটিউটের নির্বাহী সহ-সভাপতি ত্রিতা পার্সি বলেন, 'ওয়াশিংটনের অনেকেই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমশ বাড়তে থাকা ভূমিকাকে হুমকি হিসেবে দেখবে। তবে বাস্তবতা হল, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে, বিশেষত ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্কে ভালো থাকলে এতে প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের উপকার হবে।'

তিনি যুক্তি দেন, সাম্প্রতিক এ ঘটনায় ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নতুন করে নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। 'মার্কিন নীতিনির্ধারকদের দুঃচিন্তার বিষয় হওয়া উচিৎ কীভাবে আঞ্চলিক সহযোগীদের বিভিন্ন সংঘাতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে যেয়ে শান্তির দূত হিসেবে দেশটির ভূমিকা দিন দিন ছোট হয়ে তা চীনের হাতে চলে যাচ্ছে', যোগ করেন তিনি।

বিশ্লেষকদের মতে, শুক্রবারের চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের একটি 'রক্তে ভেজা' যুগের অবসান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিম-বিরোধী শিয়া সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রিয়াদ ও তেহরান সরাসরি ও পরোক্ষ আদর্শগত ও সামরিক সংঘাতে ব্যতিব্যস্ত রয়েছে।

ইয়েমেনে এখনও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনী ইরান সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এতে দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবতার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সিরিয়ায় ইরান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারকে সমর্থন দেয়। একনায়কতন্ত্র কায়েম ও দেশের মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতার দায়ে অভিযুক্ত বাশারের বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মদদপুষ্ট বিদ্রোহী দল। এছাড়াও, লেবাননে ইরান ও সৌদি আরব ২ ভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়। যার ফলে ২ দশক দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অপেক্ষাকৃত ছোট এই দেশ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।

২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ২ দেশ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সৌদি সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা নিমর আল-নিমরের শিরোচ্ছেদ করলে ইরানে বড় আকারে বিক্ষোভ দেখা দেয়। তেহরানে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসে বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দিলে ২ দেশের সম্পর্কে তলানিতে ঠেকে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যা ও যুদ্ধের খরচ বেড়ে যাওয়ায় ২ দেশই সংঘাতের প্রতি আগ্রহ হারাতে শুরু করে। সৌদি আরব ও ইরান, উভয় দেশের কর্মকর্তারাই এই তথাকথিত 'অন্ধকার যুগের' অবসানে এগিয়ে আসেন।

শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনই না, ২ দেশের কর্মকর্তারা আরও জানান, তারা প্রায় ১ দশক আগের নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি ও আরও আগের প্রযুক্তি ও বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কাজ করবেন।

বেইজিং এ চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট দলের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই, ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব আলি শামখানি ও সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাআদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান বৈঠক করেন। ছবি: রয়টার্স
বেইজিং এ চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট দলের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই, ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব আলি শামখানি ও সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাআদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান বৈঠক করেন। ছবি: রয়টার্স

বিশ্লেষকদের মতে, সংঘাতে জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক এই ঘটনা বিরল সুসংবাদ। তবে এর পূর্ণ বাস্তবায়ন কীভাবে এবং কতদিনে হবে এবং দীর্ঘদিনের বৈরিতার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ২ দেশ কীভাবে দেখবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

তবে ইরান-সৌদি আরবের বন্ধুত্বের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এক ধারণাকে বদলে দিয়েছে, যে আঞ্চলিক শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নে পশ্চিমা দেশগুলোর বিকল্প নেই।

সৌদি নেতৃবৃন্দের চিন্তাধারার বিষয়ে অবগত আছেন এমন এক সৌদি বিশ্লেষক আলি শিহাবী সিএনএনকে বলেন, 'চীন এখন এই চুক্তির "গডফাদার" এবং ইরানের কাছে চীনের যে কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টির গুরুত্ব অনেক বেশি'।

'ইরান যদি এই চুক্তি ভঙ্গ করে, তাহলে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে হুমকির মুখে পড়বে, কারণ চীন তাদের সুনামকে এই "ত্রিপাক্ষিক" চুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে', যোগ করেন শিহাবী।

 

Comments

The Daily Star  | English

Air raid sirens in northern Israel due to Iranian missiles: military

Israel says conducted 'extensive strikes' in Iran's west, while explosions near Tel Aviv, sirens blare across Israel; smoke rises after explosion in Iran’s Tabriz

2h ago