রাশিয়ায় বড় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে যুদ্ধে, প্রতারণা থেকে সাবধান

দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট’র প্রতিবেদনে জানা যায়, শুধু রুশ সেনাবাহিনীতেই নয় নেপালি নাগরিকরা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতেও কাজ করছেন।
সামরিক পোশাক পরা দুইজনের সঙ্গে হেমিল মানগুকিয়া (মাঝে)। ছবি: হেমিল মানগুকিয়ার পরিবার থেকে নেওয়া/রয়টার্স

মোহাম্মদ আসফান ভাগ্য বদলাতে 'চাকরি' নিয়ে ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। কাজ ছিল রুশ সেনাবাহিনীর সহকারীর (হেলপার)। পরিবারের কেউই ভাবেননি তাকে লাশ হয়ে ফিরতে হবে।

গত ৭ মার্চ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়—এখন পর্যন্ত আসফান হচ্ছেন সপ্তম ভারতীয়, যিনি 'লোভনীয় চাকরি'র ফাঁদে পড়ে রাশিয়ায় গিয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেননি। পরিবারের অভিযোগ, আসফানের মতো এসব চাকরিপ্রত্যাশীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সম্মুখ সমরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

প্রতিবেদনে জানা যায়—এ বিষয়ে সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'আমাদের জানা মতে, অন্তত ২০ জন এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।'

তবে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সের কাছে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে—ইউটিউব পোস্টে রাশিয়ার চাকরির পাশাপাশি সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। সেই 'ফাঁদে' পড়ে আসফান রাশিয়ায় পাড়ি জমান। দেশে তিনি একটি কাপড়ের দোকানে ম্যানেজার ছিলেন। তার স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান আছে।

আসফানের ভাই ইমরান রয়টার্সকে বলেন, 'ইউক্রেন থেকে আমাদের ফোন দিয়ে সে জানিয়েছিল তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। সে আমাদের সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু, ততক্ষণে সে ফাঁদে পড়ে গেছে।'

এতো গেল আসফানের কথা। তার আগে একইভাবে ফাঁদে পড়েছিলেন স্বদেশি হেমিল মানগুকিয়া। গত বছরের ডিসেম্বরে গুজরাট থেকে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন ২৩ বছরের এই ভাগ্যহত মানুষটি। তার মৃত্যুর সংবাদ পরিবার জানতে পায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি।

হেমিলের শ্বশুর অশ্বিন মানগুকিয়া রয়টার্সকে বলেন, 'হেমিল বলেছিল সে রুশ সেনাবাহিনী হেলপার হিসেবে কাজ পেয়েছে। তিন মাস প্রশিক্ষণ দেবে। রাশিয়ায় পৌঁছার পর বুঝতে পারলো তাকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।'

গত ৮ মার্চ রুশ সংবাদমাধ্যম দ্য মস্কো টাইমস জানায়, এই চক্রকে ধরতে কাজ করছে ভারত।

রাশিয়া অধিকৃত ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়ায় নেপালি ভাড়াটে সেনা। ছবি: আলজাজিরা থেকে নেওয়া

প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সিতে অভিযান চালিয়ে 'মানবপাচারে' জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।

এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধের জনবল সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে।

কয়েকটি এজেন্সি সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছে, মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তারা বেশ কয়েকজনকে সম্মুখ সমরে যুদ্ধের জন্য রাশিয়ায় পাঠিয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইর বার্তায় বলা হয়, ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় মাধ্যম ব্যবহার করে পাচারকারীরা লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব দিয়ে স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ভারতীয়দের রাশিয়ায় পাঠাচ্ছে। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে রণক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে।

অন্তত '৩৫ জনের' ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তদন্ত সংস্থাটি জানিয়েছে, ভুক্তভোগীদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

সিবিআই এই চক্রের চার সন্দেহভাজনের নাম বলেছে। এর মধ্যে আছে দুবাইয়ের এক এজেন্টের নাম। সেই ব্যক্তি তার সামাজিক মাধ্যমের চ্যানেলে রুশ সেনাবাহিনীতে হেলপারের চাকরির প্রচারণা করেছিলেন।

রুশ সেনাদের কয়েকজন বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, তাদেরকে বলা হয়েছিল যুদ্ধ করতে হবে না। কিন্তু, ইউক্রেনে পাঠানোর আগে তাদেরকে কালাশনিকভ রাইফেলসহ অন্যান্য অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ায় হয়।

গত ৮ মার্চ পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ জানায়, দুই কাশ্মীরি তরুণ এজেন্টের মাধ্যমে প্রতারণামূলক চাকরি নিয়ে রাশিয়ায় যাওয়ার আগে দুবাইয়ে গিয়েছিলেন। তাদের ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে দুবাই থেকে রাশিয়ায় যেতে বাধ্য করা হয়।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, রণক্ষেত্রে তারা পরিখা খননের পাশাপাশি গোলাবারুদ বহন করতেন। রাইফেল-মেশিন গান চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

মোহাম্মদ আসফানের ছবি হাতে ভাই মোহাম্মদ ইমরান। ছবি: এএফপি

বাঁচার আকুতি

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু'র প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর রুশ সেনাবাহিনীতে প্রায় ১০০ জনের মতো ভারতীয়ের নিয়োগের সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজনকে সেনাদের হেলপার হিসেবে ইউক্রেন সীমান্তে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কয়েকজন ভারতীয় শ্রমিক মস্কোয় নিজ দেশের দূতাবাসের সামনে জড়ো হয়ে সরকারের সহায়তা চেয়েছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, ভারতীয় দূতাবাসকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। নিহত হেমিল মানগুকিয়ার সহকর্মী কর্ণাটকের সামির আহমাদ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'আমরা একসঙ্গে রাশিয়ায় এসেছিলাম। হেমিল চোখের সামনেই মারা গেল। রুশ কমান্ডারকে যখন বললাম আমাদের ছেড়ে দিন, জবাবে তিনি জানালেন আমরা নাকি চুক্তিতে সই করেছি।'

অপর ভারতীয় শ্রমিক বলেছেন, 'আমাদের সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা আমাদের দিয়ে যুদ্ধ করাচ্ছে। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। বারবার বাঁচানোর আবেদন করলেও সরকার আমাদের উদ্ধারে কিছুই করেনি।'

ফাঁদে 'পা' না দেওয়ার আহ্বান

রুশ-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সুদৃঢ়। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী ইউক্রেনের আগ্রাসন চালানোর পরও নয়াদিল্লি 'চিরবন্ধু' মস্কোর সমালোচনা তো করেইনি উল্টো যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করে চলেছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এমন বন্ধুরাষ্ট্র থেকে লোকবল সংগ্রহ সহজ। তবে ফাঁদে 'পা' না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ভারত সরকার।

গত ৮ মার্চ মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ জানায়, ভারত সরকার দেশের সব নাগরিককে এই যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার অনুরোধ করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্তায় রুশ বাহিনীতে চাকরির প্রলোভনে প্রলুব্ধ না হওয়ার জন্য নাগরিকদের আহ্বান জানানো হয়েছে। বার্তায় বলা হয়েছে, এই পথ বিপদসংকুল। এমনকি, জীবনের ঝুঁকি আছে।

রাশিয়া অধিকৃত ইউক্রেনে নেপালি ভাড়াটে সেনা। ছবি: আলজাজিরা থেকে নেওয়া

প্রতারণার জালে নেপালও

ভারতের মতো এমন দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী প্রতিবেশী নেপালও। গত ১১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, যুদ্ধের জন্য রাশিয়া অন্তত ১৫ হাজার নেপালিকে নিয়োগ দিয়েছে। তাদের অনেকে ফিরেছেন 'বিধ্বস্ত' হয়ে। অনেকের আর ফিরে আসার সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনে জানা যায়, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকায় নেপালের মাওবাদীরা মূলত রাশিয়ায় যাওয়ার বিষয়ে বেশি আগ্রহী। চাকরির প্রস্তাবে প্রচুর অর্থ ও রাশিয়ায় স্থায়ীভাবে থাকার কথা বলা হচ্ছে।

গত ৭ মার্চ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, দারিদ্রের কারণে নেপাল থেকে জনবল সংগ্রহ সহজ ছিল। তবে সম্প্রতি নেপাল সরকার রাশিয়া ও ইউক্রেনে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

গতকাল ১২ মার্চ নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারায়ণ কাজি শ্রেষ্ঠ গণমাধ্যমকে বলেছেন, রুশ সেনাবাহিনী থেকে নেপালিদের ফিরিয়ে আনা 'কঠিন'।

গত ১৩ মার্চ নেপালের সংবাদমাধ্যম দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট'র প্রতিবেদনে জানা যায়, শুধু রুশ সেনাবাহিনীতেই নয় নেপালি নাগরিকরা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতেও কাজ করছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রুশ বাহিনীতে নেপালিদের সংখ্যা কয়েক শ হলেও ইউক্রেনীয় বাহিনীতে তাদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেন সরকার এ বিষয়ে নেপালকে বিস্তারিত কিছু জানাচ্ছে না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতারণা থেকে সাবধান

ভাড়াটে সেনাদের দল ভাগনার গ্রুপের কথা আশা করি পাঠকদের মনে আছে। উড়োজাহাজ 'দুর্ঘটনায়' দলপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর তাদের কথা খুব একটা আলোচনায় না এলেও মনে হচ্ছে ভাড়াটে যোদ্ধা সংগ্রহ বন্ধ নেই।

সিএনএন'র ১১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেনাদের জন্য জনবল সংগ্রহ করা হচ্ছে মূলত স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে।

নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জনবল সংগ্রহ করা হচ্ছে, তখন বিদেশে ভালো চাকরি প্রত্যাশী বাংলাদেশের তরুণদের এমন প্রতারণার ফাঁদ থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া যেতেই পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago