পুতিনের ঘাতকরা মস্কো পৌঁছে গেছেন

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সন্দেহ নেই তার মস্তিষ্ক আছে। কিন্তু, যখন বলা হয়, পুতিন ‘মস্তিষ্কে’র নাম আলেক্সাজান্ডার ডুজিন—তখন প্রশ্ন জাগে—কে এই ডুজিন?
ডুজিন, পুতিন ও দুজিনা। ছবি সূত্র: এপি
ডুজিন, পুতিন ও দুজিনা। ছবি সূত্র: এপি

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সন্দেহ নেই তার মস্তিষ্ক আছে। কিন্তু, যখন বলা হয়, পুতিন 'মস্তিষ্কে'র নাম আলেক্সাজান্ডার দুজিন—তখন প্রশ্ন জাগে—তিনি কে?

পশ্চিমের দেশগুলোয় আলেক্সাজান্ডার দুজিন সুপরিচিত। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন ও ব্রিটেনের বিবিসিসহ বিশ্ব মিডিয়ায় তাকে উপস্থাপন করা হয় প্রেসিডেন্ট পুতিনের 'মস্তিষ্ক' হিসেবে।

প্রতিবেদনগুলোয় বলা হচ্ছে, দুজিন রুশ জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক। তিনি রাশিয়ার অতীত গৌরব, বর্তমান শক্তিমত্তা ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে যে বক্তব্য দেন তা রাশিয়ায় 'নব্য নাৎসিবাদ' জাগিয়ে তুলছে।

প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর দুজিনের প্রভাব সম্পর্কে পশ্চিমের গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, তার প্ররোচনাতেই রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক হামলা' চালিয়েছেন। আলেক্সান্ডারকে পুতিনের 'আধ্যাত্মিক গুরু' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

রুশ সংবাদমাধ্যমে আলেক্সান্ডার দুজিনকে তুলে ধরা হয় একজন দার্শনিক হিসেবে। রুশদের কাছে তিনি একজন সম্মানিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, একজন তাত্ত্বিক।

আলেকজান্ডার ডুজিন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
আলেকজান্ডার ডুজিন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

গত ২০ আগস্ট মধ্যরাতে মস্কো অঞ্চলে গাড়ি বিস্ফোরণে আলেক্সান্ডার দুজিনের মেয়ে দরিয়া দুজিনা নিহত হলে প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই 'পরামর্শকে'র নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

পরদিন সামাজিক সংগঠন রুশকি গোরিজন্তের প্রধান আন্দ্রেই ক্রাসনভ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাসকে বলেন, 'বিস্ফোরণের পর দরিয়ার গাড়িতে আগুন ধরে গেলে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন।' টেলিভিশনে দেখা যায়, গাড়ির ধংসাবশেষ ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েক মিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

দরিয়া দুজিনা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
দরিয়া দুজিনা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

নিহত দরিয়া সম্পর্কে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমগুলো আরও জানায়, বাবার সব বিষয়ে একমত না হলেও তিনি উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের পক্ষে বেশ সরব। ৩০ বছর বয়সী এই নারী তার দেশের তরুণদের মধ্যে বেশ প্রভাব রাখেন।

বাবার মতো তাকেও ইউক্রেনে রুশ হামলার কট্টর সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, দরিয়া ভিডিও বার্তায় ইউক্রেনে হত্যাযজ্ঞ চালাতে রুশ সেনাদের অনুপ্রেরণা দিতেন।

সংশ্লিষ্ট রুশ কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে গতকাল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, জাতীয়তাবাদী রাশিয়ান টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় উপস্থাপক দরিয়ার টয়োটা ল্যান্ড ক্রজারটি দূর-নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরক কৌশল ব্যবহার করে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

এতে আরও বলা হয়, সাবেক সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির নতুন সংস্করণ রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) গতকাল এক বার্তায় বলেছে, 'ইউক্রেনের বিশেষ সংস্থাগুলো এই অপরাধ ঘটিয়েছে।'

গতকাল রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আরটি জানায়, সাংবাদিক দরিয়া হত্যায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে এফএসবি ইউক্রেনীয় নাগরিক নাতালিয়া ভভকের ভিডিও প্রকাশ করেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, দরিয়া যে বাসায় থাকেন ৪৩ বছর বয়সী সেই নারী তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে সেই বাসায় ঢুকছেন।

ভভক বেশ তাড়াহুড়ো করে রাশিয়া ছাড়ছেন—এমন দৃশ্যও ভিডিওতে দেখা যায়।

এতে আরও বলা হয়, ইউক্রেনের এই নাগরিক গত ২৩ জুলাই বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের দোনেস্ক প্রজাতন্ত্র থেকে রাশিয়া আসেন। তিনি দোনেস্কের লাইসেন্স প্লেট ব্যবহার করেছেন। মস্কোয় এসে তিনি গাড়ির প্লেট বদলিয়ে ফেলেন।

বোমা হামলায় দরিয়া নিহত হওয়ার পর দূর্ঘটনাস্থল পরীক্ষা করছেন সেনা সদস্যরা। ছবি: রয়টার্স

বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা পর ভভক ইউক্রেনের প্লেট নিয়ে এস্তোনিয়ায় চলে যান বলেও আরটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভভকের ভিন্ন ভিন্ন নম্বর প্লেট ব্যবহারের দৃশ্যও ভিডিওতে দেখানো হয়েছে।

বিস্ফোরণের পরপর কিয়েভের ওপর যে দায় চাপানো হয় তা অস্বীকার করে ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকার। উল্টো রাশিয়াকে দোষ দিয়ে বলেছে, এটা তাদেরই কাজ।

গতকাল জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, রুশ পার্লামেন্টের এক সাবেক সদস্যের দাবি, রাশিয়ায় পুতিনবিরোধী সংগঠন ন্যাশনাল রিপাবলিকান আর্মি গাড়ি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুতিনের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্রের মেয়েকে হত্যা করেছে।

সন্দেহ নেই দরিয়ার মৃত্যু নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আসবে। কিন্তু, এসব অভিযোগের গভীরে রয়েছে ভিন্ন দৃশ্যপট। সে বিষয়ে যাওয়ার আগে সাম্প্রতিক ২টি ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

একটি হলো—ক্রিমিয়ায় ড্রোন হামলা প্রতিহতের দাবি করেছে রাশিয়া। অপরটি—রুশ বিমানঘাঁটিতে বিস্ফোরণ।

ড্রোন হামলা প্রতিহতের ঘটনাটি ঘটে গত ২১ আগস্ট। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার নিয়োগকৃত ক্রিমিয়ার গভর্নর সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন—গতকাল ইউক্রেনের একটি ড্রোন সেভাস্তোপোল শহরের কাছে কৃষ্ণ সাগরে মোতায়েন করা রুশ নৌবহরে হামলার চেষ্টা করলে ড্রোনটি ভূপাতিত করা হয়।

রুশ বিমানঘাঁটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে গত ৯ আগস্ট। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ২০ মিনিটের দিকে অন্তত ১২ বার বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

মস্কো প্রথমে জানায়, বিমানঘাঁটিতে বিস্ফোরণ হলেও সেখানে কোনো হামলা হয়নি। পরে ১৭ আগস্ট রাশিয়া এই বিস্ফোরণকে 'নাশকতা' হিসেবে আখ্যা দেয়।

প্রেসিডেন্ট পুতিন সবসময়ই রাশিয়ার প্রতিরক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই দেশটিকে তিনি দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ও পরে তিনি বহুবার এ কথা বলেছেন।

কিন্তু, যুদ্ধ শুরুর ৬ মাসের মধ্যেই দেখা গেল অন্তর্ঘাতমূলক হামলা খোদ মস্কো পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

গতকাল ডয়েচে ভেলের রুশ সংবাদদাতা গণমাধ্যমটিকে বলেন, 'জানা গেছে, মেয়ে দরিয়ার সঙ্গে সেই গাড়িতে আলেক্সান্ডারের থাকার কথা ছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টান।'

তিনি জানান, হয়তো দরিয়া নয় সেই হামলার মূল লক্ষ্য ছিলেন আলেক্সান্ডার দুজিন। অর্থাৎ, পুতিনের 'মস্তিষ্ক'। হামলাকারীরা যদি পুতিনের 'মস্তিষ্কে' আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে তাহলে বলা যায় পুতিনের সম্ভাব্য 'ঘাতকরা' মস্কো পৌঁছে গেছেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago