ব্রিটিশরা অত্যাচারী ছিল, আমরা নিজেদের প্রতি কতটা সদয়
বৃহস্পতিবার ঘুম ভাঙতেই ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে মৃত্যুর খবরটি এমনভাবে স্থান পেয়েছিল যে চোখ এড়ানোর উপায় ছিল না।
মৃত্যুর সংবাদগুলো আমি বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ছিলাম। বিশ্ব রাজনীতিতে তার ৭ দশকের কর্মমুখর দিনগুলোর বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সব পত্রিকাই। সংবাদে আলোচিত হয়েছে তার কর্মনিষ্ঠা, দায়িত্ব সচেতনতা ও সে দেশের জনগণের আস্থা অর্জনের বিষয়গুলো। তার মৃত্যুতে ব্রিটেনের অধিবাসীরা যেভাবে শোক জানিয়েছে এবং সমবেত হয়েছে সেটা করতে তারা বাধ্য ছিলেন—এমনটি মনে হয়নি আমার।
রানির মৃত্যু সংবাদের মাঝেই এলো বাংলাদেশের আকবর আলি খানের মৃত্যুর সংবাদ। আমি তার মৃত্যুতে ব্যথিত হলাম।
আকবর আলি খানের সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় হয়ে উঠেনি। তার সম্পর্কে প্রথম জানি, যখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হলেন। তারপর তার লেখা বই পড়েছি। টিভিতে তার কথা শুনেছি। তাকে দেখে, তার কথা শুনে বাংলাদেশের প্রতি মমত্ববোধ বৃদ্ধি পায়, বাংলাদেশি হিসেবে গর্ব অনুভব হয়।
আকবর আলি খানের প্রবন্ধগুলোতে বর্ণিত তার জীবনের কিছু গল্প এবং অর্থনীতির বিভিন্ন মাত্রা আমার মনে দাগ কেটে গেছে। এর মধ্যে একটি ছিল, আকবর আলি খানের ছোটবেলার ঘটনা। ইদের দিন তার মা ১০০ টাকার একটা বান্ডিল দিয়ে তাকে দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বলেন। তিনি এক এক করে বিলি করতে শুরু করলে দরিদ্র মানুষ তার পাঞ্জাবি টানা শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন ও তার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি টাকার বান্ডিল ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে প্রাণে রক্ষা পান।
ছোটবেলার এই ছোট্ট কাহিনী থেকে তিনি পরার্থপরতার অর্থনীতির মতো জনপ্রিয় অবশ্যপাঠ্য একটা প্রবন্ধের জন্ম দিয়েছেন। তার এই আশ্চর্য ক্ষমতা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। সত্য কথা সরল ভঙ্গিতে উপস্থাপন ছিল তার আরেক দিক। তার মতো বিরল প্রতিভাধর একজন মানুষের প্রস্থান যেকোনো হৃদয় গলিয়ে দিতে যথেষ্ট।
তার মৃত্যুর দিন একটি বিতর্ক নজরে এলো। লক্ষ্য করলাম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সমালোচনা চলছে। ইংল্যান্ডের রানির মৃত্যুতে যে শোক প্রকাশ করা হচ্ছে, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও আকবর আলি খানের মৃত্যুতে সে শোক প্রকাশ হচ্ছে না। অনেকেই ব্রিটিশ শাসনের ২০০ বছরের অত্যাচার নির্যাতনের কথা স্মরণ করেছেন এবং ইংল্যান্ডের রানির সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের সম্পর্কহীনতার কথা বলেছেন।
ব্রিটেনের রানি আমাদের কেউ নয় সত্য, কিন্তু বুক উঁচু করে কি বলতে পারব যে আমরা তার প্রভাবমুক্ত?
এতদিন হলো ব্রিটিশরা বাংলা-ভারত ছেড়েছে, আমরা কি নিজেদের জন্য উপকারী কোনো বলয় নিজেরা তৈরি করতে পেরেছি? নাকি তাদের শোষণের বলয়টা কেবল ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, এ দেশীয় মুখোশ পরিয়ে বড় করেছি?
আমরা কি উৎপাদন, উন্নয়ন, সৃজনশীলতা, স্বাধীনতায় তাদের চোখে চোখ রেখে চলার জন্য তৈরি হতে পেরেছি? নাকি দয়া দাক্ষিণ্য, শিখন-পঠন, চাল-চলনে এখনও তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি?
আমাদের অঞ্চলের যে কয়টি দেশ কিছুটা উন্নতি করতে পেরেছে, তারা প্রত্যেকেই আশেপাশের দেশগুলোকে পদাবনত রাখতে চেয়েছে। দেশ বিভাজিত হয়েছে, যুগের পর যুগ পার হয়েছে, বেশিরভাগ মানুষের কাছে স্বাধীনতা অধরাই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পূর্ণ আস্বাদ ছাড়া সমৃদ্ধির কি ভিন্ন উপায় আছে?
অন্যদিকে রাজত্ব হারালেও ব্রিটিশরা কমনওয়েলথ বা বিভিন্নভাবে নিজের সঙ্গে অন্যদের সমৃদ্ধিতে বা প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী থেকেছে।
তাদের একটা ম্যাগনা কার্টার উদাহরণ আছে। সেখানে তারা অল্প কয়েকজন সম্মত হয়েছিল যে তাদের তৈরি কিছু আইন তারা কেউ কখনো ভাঙবে না। সে ধারা অব্যাহত আছে। একই মডেল চারপাশের অঞ্চলেও অনুসৃত হয়েছে এবং সমৃদ্ধির প্রভাব বিস্তার করেছে। অথচ আমাদের আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকারই এখনও দূরের স্বপ্ন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির কথা বাদ দিলাম, শোষণমুক্তিই শুধু ধরি। উদাহরণের জন্য পোশাক ও চা-শ্রমিকদের দিকে তাকান, কৃষকের দিকে তাকান, হাজারো চাকরিজীবীর দিকে তাকান, একই প্রতিষ্ঠানের উপরতলার আর নিচতলার বৈষম্যের দিকে তাকান।
দৃশ্যমান উদাহরণ চান? শতবর্ষ পরেও ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সেবা দিচ্ছে, আর সেদিনের বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে এখনই আরেকটি রেলসেতু নির্মাণ করতে হচ্ছে। আশির দশকেও ব্রিটিশের তৈরি রাস্তায় হেঁটেছি। তারপর ছোট এক জীবনে সেই রাস্তাই আরও বহুবার পুনর্নির্মিত হতে দেখেছি।
এই দেশে যখন দুর্নীতি হয়, বৈষম্য ঘটে, মানুষ শোষিত হতে থাকে- তখন কি মাস্টার দা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকির রক্তের অমর্যাদা হয় না? নাকি এই অমর্যাদা শুধু রানির মৃত্যুতে শোক প্রকাশেই সীমিত? সেই রানি, যিনি দেখেছেন ইংল্যান্ডকে সর্বোচ্চ বিস্তৃত হতে, তার আমলেই আবার সংকুচিতও হয়েছে। তিনি তারে সংযুক্ত টেলিফোনে দূরে থাকা মানুষের সঙ্গে যেমন কথা বলেছেন, সেই তিনিই আবার আধুনিক যুগের ইমেইল ব্যবহার করেছেন, টুইটারে টুইট করেছেন। অর্থাৎ, দৃশ্যত রাজত্ব হারানোর পরেও তার নেতৃত্বে ওই অঞ্চলের মানুষ শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং প্রকৃত অর্থে উন্নতিতে এখনও সারা বিশ্বে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে।
নিকটের পরিবর্তন আপনাকে সহসা আন্দোলিত করবে, সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু সূর্যের আলোকরশ্মিকে অস্বীকার করা নিশ্চয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ব্রিটেনের রানি ভালো না খারাপ, আপনার না আমার, সেসব প্রশ্নের চেয়েও জগৎব্যাপী তার পরিচিতি ও কর্মগন্ডি এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভিন্ন অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ব্রিটিশের বর্বরতা, নির্দয়তা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত। কিন্তু, তাদের অত্যাচারের ধারা আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি কি? তারা নিজেরা সংগঠিত। সংগঠিত বলেই রাজত্ব বিস্তার করতে পেরেছিল। সকলে মিলে শিখরে থাকতে এতটাই সংকল্পবদ্ধ যে তারা আজও সদর্পে টিকে আছে। নিজেদের অঞ্চল নিজেদের নাগরিকদের জন্য স্বর্গ তৈরি করে রাখতে সামর্থ্য হয়েছে। আর আমরা? নিজেদের প্রতি নিজেরা আমরা কতটা সদয় আচরণ করেছি?
লেখক: সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments