‘রাজ্য নয়, বাংলাদেশকে দাবি জানাতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের পিএইচডির বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক নদী আইন। আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ ড. আসিফ নজরুলের আলোচিত বই '"শেয়ারিং" গাঙ্গেস ওয়াটার: ইন্দো-বাংলাদেশ ট্রিটিস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ল' এ বছর প্রকাশিত হয়েছে ইউপিএল থেকে।
আন্তর্জাতিক নদী আইন বিষয়ক তার বহু গবেষণাধর্মী লেখা স্থান পেয়েছে পৃথিবীর প্রসিদ্ধ প্রকাশনায়।
সম্প্রতি তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরও ২টি খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে বলছে, এটা বাংলাদেশের জন্যে উদ্বেগজনক। কেন বাংলাদেশের জন্যে উদ্বেগজনক, করণীয় কী?
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে ভারতের ২টি খাল খনন করে পানি প্রত্যাহারের বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বলছে ভারতীয় গণমাধ্যম। কিন্তু এমন কোনো উদ্বেগ আমাদের সরকারের আছে বলে দৃশ্যমান না। তাহলে কি আমাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই?
অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল: তিস্তার পানি আরও বেশি ব্যবহার করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ যে ২টি খাল নির্মাণ ও তিস্তা ব্যারেজ সম্প্রসারণের কথা বলেছে, সেটা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই উদ্বেগজনক। এমনিতেই তিস্তার পানি নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড উদ্বেগ আছে। কারণ, এই নদীর পানি আমরা পাই না।
তিস্তা নদীর অধিকাংশ পানি অনেক উজানে সিকিমের কাছ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং জলবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়। এটা নিয়ে সিকিমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের এক ধরনের টানাপোড়েন আছে। সিকিম সরকার বারবার বলার চেষ্টা করে যে এটা 'রান অব দ্য রিভার' প্রকল্প এবং এই কারণে এখানে পানি প্রত্যাহার হয় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সবসময়ই বলার চেষ্টা করেছে যে 'রান অব দ্য রিভার' প্রকল্প হলেও সেখানে পানি প্রত্যাহার হয় সেচসহ অন্যান্য কাজের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমে বারবারই প্রতিবেদন হয়েছে যে সিকিমের কারণে পশ্চিমবঙ্গ পানি কম পাচ্ছে।
সিকিম থেকে পানি প্রত্যাহার হোক বা না হোক, বাকি যেটুকু পানি তারা পেত, সেটা ব্যবহার করত তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের মাধ্যমে। এই প্রকল্প সম্প্রসারণ করায় যৎসামান্য পানি বাংলাদেশ পেত, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, সেটা পাওয়ার ক্ষেত্রেও একটি বিরাট অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
তিস্তার পানি না থাকার কারণটা বের করতে হবে। উজান থেকে পানি প্রত্যাহার করার পরও তো বলতে পারি না যে তিস্তায় পানি নেই।
ডেইলি স্টার: এখানে বাংলাদেশের করণীয় কী?
আসিফ নজরুল: এই বিষয়টিকে বাংলাদেশ বনাম পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে দেখা যাবে না। এ বিষয়ে আপত্তি জানাতে হবে ভারত সরকারের কাছে। এ বিষয়ে কথা বলা হলে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়পক্ষ থেকেই একটা প্রচারণা চালানো হয় যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণেই তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না এবং এখানে ভারত সরকারের কিছু করার নেই।
এটা একটা ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করতে এই কথাগুলো বাংলাদেশের মিডিয়াকে খাওয়ানো হয়েছে, তারাও খেয়েছে। আমি সুনির্দিষ্টভাবে আমার গবেষণা বইয়ে লিখেছি, একটি রাজ্য সরকার তার ইচ্ছামতো একটি আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাঁধ দিতে পারে না। কারণ, আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো ভারত সরকারের এখতিয়ারে। শুধু তাই নয়, যেসব নদী ভারতের একাধিক রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা রাখার অবকাশ রয়েছে।
কাজেই তিস্তা চুক্তির জন্য তাদের কোন রাজ্য কী বলছে, সেটা বাংলাদেশের দেখার বিষয় না।
ডেইলি স্টার: বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান কিছুদিন আগে ভারতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানিই থাকে না, বাংলাদেশকে পানি দেবে কোথা থেকে।
আসিফ নজরুল: একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নদী রক্ষা কমিশনের প্রধান হয়ে তিনি এমন কথা বলতে পারেন, এটা আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। তিস্তার পানি নেই কেন? নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েও তিনি সেটা জানেন না কেন?
তিস্তার পানি না থাকার কারণটা বের করতে হবে। উজান থেকে পানি প্রত্যাহার করার পরও তো বলতে পারি না যে তিস্তায় পানি নেই।
সমস্যা হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন পদে থাকা মানুষগুলো এমনভাবে কথা বলেন, যেন তারা বাংলাদেশের সরকার নয়, মনে হয় তারা ভারত সরকারের স্বার্থ দেখছেন। নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যকে আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক মনে করছি। এই বক্তব্যের পর এই পদে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার তার নেই। তাকে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থে।
পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারত ২টি কারণে বাংলাদেশের সুবিধা দেখবে। একটি হচ্ছে, যদি এর জন্য কোনো আইন থাকে এবং অপরটি হলো, যদি দেশে ওই আইন অনুযায়ী দাবি আদায় করার মতো সরকার থাকে।
ডেইলি স্টার: শুষ্ক মৌসুমে যদি তিস্তায় পানি না-ই থাকে, তাহলে ভারত প্রত্যাহার করবে কী? নতুন ২টি খাল খনন করে কী করবে?
আসিফ নজরুল: তিস্তায় পানি নেই তা নয়। ভূগর্ভস্থ পানিও পুনরায় ভর্তি হয়। তিস্তার পশ্চিমবঙ্গ অংশে কোনো কোনো জায়গায় পানি অনেক বেশি। যেখানে পানি প্রত্যাহার করা হয়, তার নিচের অংশে পানি কম থাকে।
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান কী বুঝে এটা বলেছেন, তা আমি জানি না। তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন যে শুষ্ক মৌসুমে পশ্চিমবঙ্গেও তিস্তায় খুব কম পানি থাকে।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, খুব কম থাকলেও সবটা যদি পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যায় তাহলে আমি কী পেলাম?
ডেইলি স্টার: ড. আইনুন নিশাত বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ পানি প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় মারাত্মক প্রভাব পড়বে। খাল খনন করে পশ্চিমবঙ্গ পানি প্রত্যাহার করবে তাদের সুবিধায়। বাংলাদেশের ক্ষতি হলো কি না, তা তারা দেখবে কেন?
আসিফ নজরুল: পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারত ২টি কারণে বাংলাদেশের সুবিধা দেখবে। একটি হচ্ছে, যদি এর জন্য কোনো আইন থাকে এবং অপরটি হলো, যদি দেশে ওই আইন অনুযায়ী দাবি আদায় করার মতো সরকার থাকে।
এ বিষয়ে আইন আছে। গঙ্গা চুক্তির একটি অনুচ্ছেদে আছে, অন্য সকল নদীর পানি সাম্য, ন্যায্যতা এবং কোনো ক্ষতি না করে সাম্যতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি হবে। এটাই যদি হয়, তাহলে একটি দেশ সব নিয়ে যাবে, তা তো হয় না। সেখানে ২টি দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম বা অন্য কোনো রাজ্যের মধ্যে ভাগের কথা বলা হয়নি।
যদি গঙ্গা চুক্তি মানি, এর একটি ধারা অনুযায়ী, তিস্তা নদীর সব স্ট্রেচের মধ্যে মোট যে পরিমাণ পানি আছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের আলোচনায় বসতে হবে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ভাগাভাগি করতে হবে। কিংবা আমাদের ২০১১ সালের বেসিন সমঝোতা অনুযায়ী অববাহিকাভিত্তিক চুক্তি করতে হবে।
নদীর পানি থেকে ভারত পুরোটা নিয়ে যাবে, বাংলাদেশ কিছুই পাবে না, এটা আন্তর্জাতিক আইনের, এমনকি গঙ্গা চুক্তির সম্পূর্ণ বরখেলাপ।
যেহেতু সরকার অ্যাগ্রেসিভলি প্রো-ভারত অবস্থান নিয়েছে, এ জন্য ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মিডিয়া ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যেও ভারত অসন্তুষ্ট হতে পারে বা ভারতের সঙ্গে এই সরকারের সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে, এমন কিছু বলতে বা লিখতে অনীহা দেখতে পাই। এটা দেশের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করি।
ডেইলি স্টার: তিস্তা চুক্তি হবে, সেই সম্ভাবনা দেখতে পান? চুক্তি যদি হয়ও, পশ্চিমবঙ্গের খাল খনন ও পানি প্রত্যাহার প্রকল্পের পর কতটা সুফল পাবে বাংলাদেশ?
আসিফ নজরুল: প্রথমত, এই চুক্তির সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, এই সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ফলে, ভারতের সঙ্গে তাদের দর কষাকষির সক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল। জনগণের ওপর নির্ভর না করে ভারতের ওপর নির্ভর করায় এই সরকার শক্ত কণ্ঠে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করবে, তা আমি বিশ্বাস করি না।
যদি ধরে নেওয়া হয় যে চুক্তি হবে, সেক্ষেত্রে সংকট হবে তা বাস্তবায়ন করা।
কিন্তু বাস্তবায়নের দাবি তো তখন করতে পারবেন, যখন আপনার কোনো চুক্তি আছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী আইনি চাপ থাকবে।
একটি প্রকল্প রাতারাতি বাস্তবায়ন হয় না। এর জন্য সময় লাগবে। এখনই যদি তিস্তা চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের প্রকল্পে পরিবর্তন আনাও সম্ভব। বিকল্প কোনো পদ্ধতিতে তারা যেতে পারবে।
ডেইলি স্টার: এই প্রকল্পের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার জমি অধিগ্রহণও করে ফেলেছে। এমন একটি প্রকল্পের বিষয়ে আমরা জানলাম ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে। বাংলাদেশের সরকার বা বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কথা বললেন না কেন?
আসিফ নজরুল: যেহেতু সরকার অ্যাগ্রেসিভলি প্রো-ভারত অবস্থান নিয়েছে, এ জন্য ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মিডিয়া ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যেও ভারত অসন্তুষ্ট হতে পারে বা ভারতের সঙ্গে এই সরকারের সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে, এমন কিছু বলতে বা লিখতে অনীহা দেখতে পাই। এটা দেশের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করি।
সরকার যদি এই বিষয়টি না জেনে থাকে, তাহলে সেটা সরকারের অত্যন্ত অদক্ষতার প্রমাণ। আর সরকার যদি জেনেও কিছু না বলে থাকে, তাহলে সেটা অত্যন্ত দেশপ্রেমহীন কাজ।
এই সরকার যখন অদক্ষতার পরিচয় দেয় বা দেশপ্রেমহীনতার পরিচয় দেয়, তখন আমি মোটেও অবাক হই না। কারণ, তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতা না থাকলে একটি সরকারের এমন অবস্থাই হয়।
ডেইলি স্টার: বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা নিয়ে রাজনীতি যতটা হয়, দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আসিফ নজরুল: আদানির চুক্তিটি বিরাট দেশদ্রোহিতামূলক চুক্তি। এটা নিয়ে কয়জন কথা বলছেন? আমাদের অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, কেউ কি কথা বলেছেন? তারা কি তিস্তা চুক্তি নিয়ে কথা বলেছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কথা বলেন না। এটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগে।
সরকারের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, পরিবেশ কর্মীসহ সবার দায়িত্ব এটা। সরকারের দায়িত্ব বেশি। কিন্তু আমরা আমাদের দায়িত্বটুকুও পালন করি না।
Comments