টাইগার পাস: বাঘেরা সত্যিই এখানে চলাচল করতো

চট্টগ্রামের টাইগার পাস মোড়ে অবস্থিত বাঘের ভাস্কর্য। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

বন্দর নগরীর টাইগার পাস এলাকায় একটি চায়ের দোকানে চা পান করছিলেন ৮০ বছর বয়সী সালেহ আহমেদ। টাইগার পাস সংলগ্ন দেওয়ান হাট এলাকায় তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এই এলাকায় এক সময় বাঘের উপদ্রব নিয়ে প্রচলিত কাহিনী সম্পর্কে জানতে চাইলে তার চোখে মুখে উৎসাহের ভাব ফুটে ওঠে।

তিনি বলতে শুরু করেন, 'আমি নিজে কখনো বাঘ দেখিনি, কিন্তু দাদা-দাদির কাছ থেকে শুনেছি যে এই অঞ্চলে এক সময় পাহাড় থেকে বাঘ নেমে আসতো। আমার দাদা বাঘ দেখেছিলেন। তার এক বন্ধু একবার ফাঁদ দিয়ে বাঘ শিকার করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।'

এক সময় চট্টগ্রাম শহরের এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে বাঘ ঘুরে বেড়াতো। নগরের প্রবীণ নাগরিকেরা বলেন, আসলে তখন চট্টগ্রাম শহর খুব একটা বড় ছিল না। ১৯৫০-এর দশকেও প্রায় ১৬ বর্গমাইলের একটি ছোট শহর ছিল এটি।

তাদের মতে, বর্তমান চট্টগ্রাম নগরীর বেশিরভাগ এলাকা সেই সময় পাহাড়  ও জঙ্গলে ঘেরা ছিল, যা এই অঞ্চলকে বাঘ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নিরাপদ  আবাসস্থলে পরিণত করেছিল।

মাঝে মাঝে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসতো বাঘ। তারা চুপি চুপি গৃহস্থের গোয়ালঘরে ঢুকে গবাদি পশু শিকার করে নিয়ে যেতো। মাঝে মাঝে তারা মানুষের মুখোমুখি হয়ে যেত। বাঘের হাতে মানুষ মারা পড়তো। অন্যদিকে অনেক সাহসী শিকারি ফাঁদ পেতে ও বন্দুক দিয়ে বাঘ শিকার করতো।

বর্তমানে চট্টগ্রামের কোনো পাহাড়েই আর বাঘ নেই।

বন্দর নগরীর অনেক এলাকার নামকরণ করা হয়েছে বাঘের নামে। যেমন: টাইগার পাস, লেপার্ড পাস এবং বাঘ ঘোনা।

টাইগার পাস এলাকাটি বন্দর নগরীর প্রধান অংশে অবস্থিত। ৪ রাস্তার সংযোগস্থলে অবস্থিত টাইগার পাস চট্টগ্রাম নগরীর একটি ব্যস্ত মোড়। নগরীর অন্যান্য চৌরাস্তার মতো টাইগার পাসও পাহাড়-টিলা দিয়ে ঘেরা। নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এই এলাকার রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন বলেন, 'এই এলাকা দিয়ে প্রায়ই বাঘ চলাচল করতো। তাই এর নামকরণ হয়েছে টাইগার পাস।'

ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রাম শহরে বেড়ে ওঠা অধ্যাপক সেন বলেন, 'বর্তমানে যেখানে টাইগার পাস এলাকা রয়েছে, সেখানে লোকজন বাঘকে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে দেখতো। তাই তারা এই জায়গার নাম দিয়েছে  টাইগার পাস।'

তিনি বলেন, 'আব্দুল হক চৌধুরী রচিত "বন্দর শহর চট্টগ্রাম" বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯ শতকের শেষের দিকেও চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাঘের অবাধ বিচরণ ছিল।'

'বন্দর শহর চট্টগ্রাম' বইয়ের সূত্র ধরে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা ছিল টাইগার পাস, যা দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে সমুদ্রের পাড়ে চলে যায়। ১৮৬২ সালে চট্টগ্রামে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান আর্থার লয়েড ক্লে তার "লিভস ফ্রম এ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গল" বইয়ে লিখেছেন, "চট্টগ্রাম ছিল অনেকগুলো পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা। এখানে দিনেদুপুরেও বাঘের গর্জন শোনা যেত।" তখন বাঘ শিকারের জন্য সরকার পুরস্কার ঘোষণা করতো। লয়েড ক্লে অফিসে যোগদানের পর এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি বাঘ শিকার করা হয়েছিল এবং পুরস্কারের জন্য আনা হয়েছিল।'

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নানও বলেন, ১৯ শতকের শেষের দিকেও চট্টগ্রামের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতো বাঘ।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মান্নান আরও বলেন, 'আমি তখন ছোট। ১৯৫০-এর দশকে চট্টগ্রাম ছিল প্রায় ১৬ বর্গমাইলের ছোট এক শহর। ১৯৫৩ সালে এই শহরে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। শহরটি বেশ কয়েকটি পাহাড়, টিলা এবং জঙ্গলে ঘেরা ছিল। গণপূর্ত বিভাগের চুন ও লোহার রড ওই এলাকায় গুদামে রাখা হতো বলে বর্তমান নিউমার্কেট এলাকাকে চুনার গুদাম বলা হতো।'

'আমি দাদা-দাদির কাছ থেকে শুনেছি, পাহাড় থেকে নেমে এসে বাঘেরা একসময় মানুষকে হত্যা করতো। তারা গৃহস্থ বাড়ির গোয়ালঘরে ঢুকে গবাদি পশুও শিকার করতো। আবার অনেক সাহসী শিকারি বাঘ শিকার করতো,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

BNP expects positive response from parties on election timeline

BNP believes this historic announcement will help overcome the political deadlock in Bangladesh and make the path to democracy smoother

27m ago