দেশের পুঁজিবাজার আসলেই ‘গুপ্তধন’?

দেশের পুঁজিবাজার

'ফ্লোর প্রাইস' বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে 'আকর্ষণহীন' করে তুলছে বলে মন্তব্য করেছে এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চ। কেননা, এটি একটি বিধিনিষেধ। গত মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এই বিধিনিষেধটি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ঘাটতি তৈরি করেছে।

অথচ, প্রায় ২ বছর আগে এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে 'লুকিয়ে থাকা রত্ন' বা 'হিডেন জেম' বলে আখ্যা দিয়েছিল।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বাড়ানোর বিশাল সম্ভাবনা বিবেচনা করে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানটি একে 'গুপ্তধন' বলে গণ্য করেছিল। পাশাপাশি, তারা এও আশা করেছিল যে এ দেশের পুঁজিবাজার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে।

আসলেই কি আমাদের পুঁজিবাজার কোনো 'গুপ্তধন'? আর এই যে, মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে এটি 'আকর্ষণহীন' হয়ে পড়লো তা কি শুধুই ফ্লোর প্রাইসের কারণে? পুঁজিবাজারে যে আস্থার সংকট তা কি নতুন কিছু?

আসলে, পুঁজিবাজারে আস্থা সংকটের কারণ অনেক। এগুলো নতুন কোনো কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলা সুশাসনের অভাবই এর মূল কারণ। দিনে দিনে, এ বিষয়গুলো আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আন্দাজ করা যায় যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই পরিস্থিতি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তারা ২০১৮ সাল থেকে তাদের শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। গত ৫ বছরে তারা ধীরে ধীরে এ দেশে তাদের বিনিয়োগ অনেক কমিয়ে এনেছেন।

ধারাবাহিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ কমতে থাকায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ সংক্রান্ত তথ্য দিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) মৌখিকভাবে নিষেধ করে দেয়। এরপর থেকে এই তথ্য ডিএসই প্রকাশ করে না।

বিদেশিদের আস্থাহীনতার প্রধান কারণ হচ্ছে—বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার মান বছরের পর বছর কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। একই সঙ্গে রিজার্ভও কৃত্রিমভাবে বেশি দেখিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পেরেছেন যে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর কোনো কৃত্রিম প্রভাব বেশিদিন টিকবে না। এটি যেকোনো সময় খুব বাজেভাবে ধরা পড়ে যাবে। তখন টাকার দামে হঠাৎ বড় ধরনের পতন ঘটবে। এটি গোটা অর্থনীতিকেই চাপে ফেলে দিতে পারে। তাদের ধারণা যে সত্যি ছিল, তা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।

পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার আরেকটি কারণ হলো—হঠাৎ নীতি পরিবর্তন করার প্রবণতা। এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যায়, সরকার তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আচমকা হস্তক্ষেপ করেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

যেমন, তিতাস গ্যাসের কথা বলা যায়। পূর্ব বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০১৫ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন লাইন বিতরণের জন্য তিতাসের চার্জ কমিয়ে দেয়। ফলে ৫ মাসের মধ্যে ইউটিলিটি প্রতিষ্ঠানটির বাজারমূল্য ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি কমে যায়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে তারা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেন।

২০১৮ সালে সেসময়কার তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কোম্পানি গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের হস্তক্ষেপ দেখা গেছে।

সরকারের এ ধরনের হঠাৎ নীতিগত পরিবর্তনের তালিকা অনেক দীর্ঘ।

শুধু তাই নয়, বিএসইসি নিজেই মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ বাড়িয়েও বাজারে হস্তক্ষেপ করে। বিনিয়োগকারীরা যখন মিউচুয়াল ফান্ডে তাদের দেওয়া অর্থের বিপরীতে টাকা পাওয়ার অপেক্ষা করছিলেন, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত তাদেরকে আরও ১০ বছর অপেক্ষা করতে বাধ্য করে। সন্দেহ নেই, পুঁজিবাজারে দরপতন ঠেকাতে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আটকে রাখার এই নীতি অনেককে ক্ষুব্ধ করেছে।

বিএসইসির হস্তক্ষেপের সর্বশেষ উদাহরণ হলো—ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ। পুঁজিবাজারের সূচককে কৃত্রিমভাবে ঊর্ধ্বমুখী রাখতে বিএসইসি ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে। যে দামের নিচে শেয়ারের দাম নামতে পারে না।

এর পরের বছর ফ্লোর প্রাইস তুলে না নেওয়া পর্যন্ত বাজারে সব বিনিয়োগ আটকে ছিল। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে বিএসইসি ফ্লোর প্রাইসনীতি থেকে সরে আসে।

বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন, বিএসইসি বুঝতে পেরেছিল যে এটি ভুল উদ্যোগ। তারা আশা করেছিলেন, এমন সিদ্ধান্ত আর আসবে না। কিন্তু, বছর না ঘুরতেই আবার ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। এই সিদ্ধান্তের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক কারণে পুঁজিবাজারের সূচককে কৃত্রিমভাবে ঊর্ধ্বমুখী রাখতে এই নীতি নেওয়া হয়েছে। অথচ ফ্লোর প্রাইসের কারণে গত এক বছর ধরে বিনিয়োগকারীরা লেনদেনই করতে পারছেন না।

কৃত্রিমভাবে দাম ধরে রাখায় কেউ শেয়ার কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় বাজারে সব ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার আটকে আছে।

এসবের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে ব্যাপক কারসাজিও বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে। বাজারে এটি একটি সাধারণ দৃশ্য যে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার শীর্ষ দরবৃদ্ধি বা শীর্ষ টার্নওভারের তালিকায় চলে আসছে। তাই বেশি ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারই কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন।

বিএসইসি কারসাজি ধরলেও খুব হালকা শাস্তি দিয়ে অপরাধীদের পার করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। কারসাজি করে যারা অবৈধভাবে টাকা আয় করছেন, তাদের জন্য সত্যিই এ বাজার 'গুপ্তধন' হিসেবে কাজ করছে বললে হয়ত বেশি বলা হবে না। মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে এখানে শেয়ারের দাম ৬০ গুন পর্যন্ত বাড়তে দেখা গেছে।

সুতরাং, এটি যে তাদের জন্য 'গুপ্তধন'র চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, তা প্রমাণিত।

তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুশাসনের অভাব খুবই সাধারণ বিষয়। এটি পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস হারানোর আরও একটি কারণ। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে পরিচালিত হয়। তাদের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়েও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনেক সন্দেহ আছে।

সার্বিকভাবে সুশাসন পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনার মূল চাবিকাঠি। সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে—আস্থা ফিরে না এলে এই বাজার দেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত ভূমিকা রাখতে পারবে না। আর তা ফেরানোর জন্য সবার আগে ফেরাতে হবে সুশাসন।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে বাজার কারসাজি কমাতে হবে। এ ছাড়াও, অর্থনৈতিক নীতিতে বন্ধ করতে হবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।

আহসান হাবিব: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

8h ago