কেন হামাসকে ‘টেররিস্ট’ বলে না বিবিসি

কেন হামাসকে টেররিস্ট বলে না বিবিসি
ষষ্ঠ দিনের মতো চলছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। গাজা থেকে আজ বৃহস্পতিবার তোলা ছবি। ছবি: এএফপি

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসকে 'টেররিস্ট' হিসেবে উল্লেখ না করায় নিজ দেশে প্রশ্নের মুখে পড়েছে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসি। ইসরায়েলের ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমে বিবিসিতে হামাসকে 'টেররিস্ট' হিসেবে উল্লেখ না করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী। কঠোর ভাষায় সমালোচনার পাশাপাশি বিবিসির নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লিভারলি এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী লুসি ফ্রেজার বিবিসির নীতি সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে লেবার পার্টির নেতা স্যার কেয়ার স্টারমার বলেছেন, বিবিসি কেন ওই শব্দ ব্যবহার করছে না তার ব্যাখ্যা দিতে হবে।

সমালোচনার ব্যাখ্যা দিয়ে গতকাল বিবিসির অনলাইনে এ বিষয়ে লিখেছেন বিবিসির ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স এডিটর জন সিম্পসন।

নীতিগত কারণেই বিবিসি কাউকে টেররিস্ট বলতে পারে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

যদিও দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যান্ট শাপস বলেছেন, এই নীতি লজ্জাজনক।

বিবিসির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, কেউ না বললে বিবিসির সাংবাদিকেরা নিজেরা কখনোই এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন না, এটি তাদের দীর্ঘদিনের চর্চা

জন সিম্পসন বলেন, কাউকে টেররিস্ট বলার অর্থ হচ্ছে আপনি পক্ষ নিচ্ছেন।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাপস বলেছেন, বিবিসির নৈতিক অবস্থান ঠিক করা জরুরি।

রেডিও এলবিসিকে শাপস বলেন, এখানে সমান দুটি পক্ষ আছে এমন ধারণাটাই আমি মনে করি লজ্জাজনক।

তবে বিবিসির মুখপাত্র জানিয়েছেন, আমরা সবসময় আমাদের ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখি। যে কেউ আমাদের প্রতিবেদন শুনলে বা দেখলে সেখানে তারা টেররিস্ট শব্দটি বহুবার শুনতে পাবেন। কারা শব্দটি বলেছেন তাও স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবেদনে। যেমন-যুক্তরাজ্য সরকার।

এটি এমন এক পন্থা যা কয়েক দশক ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমও সেটি করে থাকে।

বিবিসি একটি স্বাধীন সম্প্রচারমাধ্যম। যার কাজ হচ্ছে যা কিছু ঘটছে তা সঠিকভাবে তুলে ধরা যাতে আমাদের দর্শক-শ্রোতারা ঘটনা সম্পর্কে জেনে তা সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

বিবিসির ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স এডিটর জন সিম্পসন তার লেখায় বলেন, সরকারের মন্ত্রী, কলামিস্ট, সাধারণ মানুষ- সবারই জিজ্ঞাসা বিবিসি কেন হামাসের বন্দুকধারীরা যারা ইসরায়েলের দক্ষিণে ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছে তাদের টেররিস্ট বলছে না।

তিনি বলেন, এর উত্তর বিবিসির প্রতিষ্ঠাকালীন নীতিতেই রয়েছে।

সন্ত্রাসবাদ একটি চাপিয়ে দেওয়া শব্দ, যা মানুষ এমন কোনো সংগঠন সম্পর্কে বলে যা তারা নৈতিকভাবে অপছন্দ করে।

তিনি লিখেছেন, কাকে সমর্থন করতে হবে এবং কাকে নিন্দা করতে হবে - কে ভালো মানুষ আর কে খারাপ মানুষ সেটি জানানো বিবিসির কাজ নয়।

আমরা আমাদের প্রতিবেদনে নিয়মিত উল্লেখ করি যে ব্রিটিশ ও অন্যান্য সরকার হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিন্দা করেছে, আর এটি তাদের কাজ। আমরা অতিথিদের সাক্ষাৎকারও চালাই যেখানে তারা হামাসকে সন্ত্রাসী হিসেবে বর্ণনা করেন।

মূল বিষয় হলো এটি আমরা নিজেরা বলি না। আমাদের কাজ হলো আমাদের অডিয়েন্সকে ঘটনাগুলো তথ্য দিয়ে জানানো যাতে তারা তাদের নিজেদের মত তৈরি করে নিতে পারেন।

টেররিস্ট শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য যারা আমাদের আক্রমণ করেছে তাদের অনেকেই আমাদের ছবি দেখেছে, আমাদের অডিও শুনেছে বা আমাদের প্রতিবেদন পড়েছে এবং আমাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তারা তাদের মনস্থির করেছেন। তাই বলা যাবে না আমরা সত্যকে কোনোভাবে লুকিয়ে রেখেছে কিংবা আমরা সত্য থেকে দূরে আছি।

বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে শিশু, শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হত্যা কোনোভাবেই কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।'

পাঁচ দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে অভিজ্ঞ বিবিসির এই জেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, ৫০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করছি। ইসরায়েলে এ ধরনের হামলার পরিণতি আমি দেখেছি এবং লেবানন এবং গাজার বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিণতিও আমি নিজে দেখেছি। আপনি আপনার মন থেকে এ ধরনের ভয়াবহ জিনিস কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবেন না।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে সংগঠনের সমর্থকেরা এগুলো চালিয়েছে তাদেরকে টেররিস্ট সংগঠন বলা আমাদের শুরু করা উচিত। কারণ তার অর্থ হবে বস্তুনিষ্ঠ থাকার দায়িত্ব ত্যাগ করা।

বিবিসি সব সময়ই এমন ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিবিসির প্রতিবেদকদের স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছিল নাৎসিদের মন্দ বা খারাপ না বলতে।

সর্বোপরি বিবিসির একটি নথিতে বলা হয়েছে বাগাড়ম্বর করার কোনো জায়গা নেই। আমাদের শান্ত ও ধীর থাকতে হবে।

আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি যখন ব্রিটেনে বোমা বর্ষণ করছিল এবং নিরীহ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছিল তখনও কঠিন হলেও, এই নীতিটি বিবিসির কর্মীরা মেনে চলেছেন। বিবিসিতে মার্গারেট থ্যাচার সরকারের কাছ থেকে চাপ ছিল এবং আমার মতো সাংবাদিকের ওপরও ব্যাপক চাপ ছিল বিশেষ করে যখন ব্রাইটন বোমা হামলার পর যেখানে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন এবং বহু নিরপরাধ মানুষ হতাহত হয়েছিল।

কিন্তু তারপরও আমরা আমাদের সেই নীতি ধরে রেখেছিলাম এবং এখনও আজ পর্যন্ত রেখেছি।

আমরা কোনো পক্ষ নিই না। আমরা কোনো 'মন্দ' বা 'কাপুরুষতা'র মতো চাপিয়ে দেওয়া শব্দ ব্যবহার করি না। আমরা 'টেররিস্ট'দের কথা বলি না। শুধু আমরাই নই, বিশ্বজুড়ে নন্দিত আরও অনেক গণমাধ্যও ও সংবাদ সংস্থাও এই নীতি মেনে চলে।

কিন্তু বিবিসি বিশেষ মনোযোগ পায়, যার একটি কারণ হতে পারে, যুক্তরাজ্যের রাজনীতি, গণমাধ্যমে সমালোচকেরা আছেন, আরেকটি কারণ হতে পারে এধরনের বিষয়গুলো প্রচারের ক্ষেত্রে আমরা যতটা সম্ভব বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার নীতি ধরে রেখেছি।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago