ভারতের পেসে পিষ্ট শ্রীলঙ্কার দুঃস্বপ্নময় রাতে রেকর্ড হার
ভারতের পেসত্রয়ীর সামনে মুম্বাইয়ে দুঃস্বপ্নময় এক সন্ধ্যা পার করেছে লঙ্কানরা। উইকেট যখন তাদের বাকি মাত্র দুই, তখন স্কোরবোর্ডে রান পাড়ি দেয়নি ২৯। ভারতের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কাকে দেখে পাড়ার দলই ভেবে বসতে পারেন কেউ। শেষমেশ শ্রীলঙ্কা অলআউট হয়ে গেছে ৫৫ রানেই। একই সঙ্গে প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করেছে ভারত।
বিশ্বকাপে কোন টেস্ট খেলুড়ে দেশের সর্বনিম্ন রানে অলআউট হওয়ার 'লজ্জায়' পড়েছে লঙ্কানরা। ৩০৩ রানের হারে বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে রানের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় হারও মিলেছে তাদের। মোহাম্মদ শামির ৫ উইকেটের আগে মোহাম্মদ সিরাজের ৩ উইকেট ও জাসপ্রিত বুমরাহর ১ উইকেটের স্পেল তাদের মাটিচাপাই দিয়ে দেয়। সাত ম্যাচে সাত জয়ে ভারত নিশ্চিত করে ফেলে সেমিফাইনাল। আর বিশাল হারে লঙ্কানরা সাত ম্যাচে দুই জয়ে সেমির দৌড়ে অনেক দূরেই চলে গেল।
বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ৩৫৭ রানের বিশাল পুঁজি নিয়ে নেমে প্রথম বলেই উইকেট তুলে নেয় ভারত। জাসপ্রিত বুমরাহর আউটসুইঙ্গারে এলবিডাব্লিউ হয়ে বিদায় নেন পাথুম নিসাঙ্কা। সিরাজ এসে তার প্রথম বলেও উইকেট শিকার করেন। দিমুথ করুনারত্নেকেও শূন্য রানে ফিরিয়ে দেন ভিতরে আসা বলে এলবিডাব্লিউ বানিয়ে। বুমরাহ-সিরাজ জুটি সুইং পেয়ে ঝাঁঝালো বোলিং করতে থাকেন। যেন আগুনের গোলা ছুড়ছিলেন তারা। দ্বিতীয় ওভারে সিরাজ আরও একজনকে শিকার বানিয়ে ফেলেন।
সাদিরা সামারাবিক্রমা সিরাজের তোপের মুখে বাইরের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে দেন। কুশল মেন্ডিসকেও যখন পরের ওভারে এসে সিরাজ দুর্দান্ত আউটসুইঙ্গারে বোল্ড করেন, শ্রীলঙ্কার স্কোরবোর্ডে রানের থেকে উইকেট সংখ্যা বেশি। ৩ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলা লঙ্কানরা চোখে আঁধার দেখছিল যেন। ক্ষণিকেই তারা ছিটকে যায় ম্যাচ থেকে। এঞ্জেলো ম্যাথিউজ এসে অন্তত ক্রিজে বেঁচে থাকতে পারেন। সঙ্গে চারিথ আসালাঙ্কাও সিরাজ-বুমরাহ জুটির আক্রমণে টিকে থাকতে পারেন।
৫ ওভারে ৭ রানের স্পেলে আর কোন উইকেট পাননি বুমরাহ। ৫ রানে ৩ উইকেটের চার ওভারের স্পেল শেষে সিরাজকে বিরতি দেন রোহিত। শ্রীলঙ্কা রেহাই পাবে কোথা থেকে, মোহাম্মদ শামি এসে মেডেন দিয়ে দুজনকে পাঠিয়ে দেন প্যাভিলিয়নে। আগের ২৩ বলে মাত্র ১ রান আনতে পারা আসালাঙ্কা শামির বলে চার মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন পয়েন্টে। দুশান হেমন্ত এসে প্রথম বলেই কিপারে ক্যাচ দিয়ে দেন।
শ্রীলঙ্কা পাওয়ারপ্লেতেই হারিয়ে ফেলে ৬ উইকেট। ১৪ রানে থাকা লঙ্কানদের তখন বিশ্বকাপে ৩৬ রানের সর্বনিম্ন স্কোর চোখ রাঙানি দিচ্ছে। ২২ রানে যেতে না যেতেই আরেকটি উইকেট হারিয়ে বসে তারা। ১২তম ওভারে লোকেশ রাহুলের দুর্দান্ত রিভিউয়ের আবদারে উইকেট পান শামি। পরের ওভারে এসে ততক্ষণ একপাশে নিজেদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখা ম্যাথিউজকেও ফিরিয়ে দেন শামি। ম্যাথিউজকে বোল্ড করে দিলে ২৯ রানেই আট ব্যাটার নাই হয়ে যায় লঙ্কানদের।
মাহিশ থিকশানা ও কাসুন রাজিতা এসে অপ্রত্যাশিতভাবে রান বের করে ফেলেন। দুজনেই দুই অঙ্কে পৌঁছে যান। ১৪ রানে শেষমেশ রাজিতা যখন আউট হন, শ্রীলঙ্কা অবশ্য পৌঁছে যায় ৪৯ রানে। শামি পেয়ে যান ফাইফার, বিশ্বকাপে যা তার তৃতীয়। রাজিতার উইকেট নিয়ে ভারতের হয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীও বনে যান শামি। ৫৫ রানে শেষ উইকেট পড়ে গেলে শ্রীলঙ্কার দু:স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে।
এদিন টস জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় শ্রীলঙ্কা। দিলশান মাদুশাঙ্কার করা ইনিংসের প্রথম বলেই চার মেরে শুরু করেন ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা। কিন্তু পরের বলেই পাল্টা আঘাত হানেন মাদুশাঙ্কা। বোল্ড করে দেন ভারতীয় অধিনায়ককে। তাতে ভালো সূচনাও পায় লঙ্কানরা। কিন্তু নিজেদের ভুলেই তার সদ্ব্যবহার করতে পারেনি তারা।
অধিনায়কের বিদায়ের পর আরেক ওপেনার শুবমান গিলকে নিয়ে দলের হাল ধরেন বিরাট কোহলি। মাদুশাঙ্কার করা পঞ্চম ওভারে টানা দুই বলে বাউন্ডারি মেরে রানের খাতা খোলেন গিল। পঞ্চম বলে সোজা মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু লোপ্পা ক্যাচ মিস করে বসেন মাদুশাঙ্কা। গিল তখন ব্যাটিং করছিলেন ৮ রানে।
আর দুশমান্থা চামিরার করা পরের ওভারের প্রথম ওভারে জীবন পান কোহলি। ফ্লিক করতে গেলে তিনিও বোলারের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ লুফে নিতে পারেননি চামিরা। ফলে তিন বলের ব্যবধানে জীবন পান ভারতের দুই ব্যাটারই। আর জীবন পেয়ে দারুণ ব্যাটিং শৈলী দেখান তারা। গড়েন ১৮৯ রানের দারুণ এক জুটি। মূলত এই জুটিতেই বড় পুঁজির ভিত পেয়ে যায় ভারত।
গিলকে ফিরিয়ে এ জুটি ভাঙেন সেই মাদুশাঙ্কাই। তার স্লোয়ার বাউন্সে বল আপার কাট করতে গেলে উইকেটরক্ষক কুশল মেন্ডিসের গ্লাভসে ধরা পড়েন এই ওপেনার। ফলে ৮ রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করেন গিল। ৯২ বলে ১১টি চার ও ২টি ছক্কায় ৯২ রান করেন এই ওপেনার।
গিলের মতো কোহলিকেও হতাশ করেন মাদুশাঙ্কা। যেভাবে ব্যাটিং করছিলেন তাতে মনে হয়েছিল শচীন টেন্ডুলকারের ৪৯তম সেঞ্চুরি রেকর্ড শচীনের মাঠেই ছুঁয়ে ফেলবেন কোহলি। তবে ব্যক্তিগত ৮৮ রানে মাদুশাঙ্কার কাটারে শর্ট কভারে নিসাঙ্কার হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন তিনি। ৯৪ বলে ১১টি চারের সাহায্যে সাজান নিজের ইনিংস।
তবে এরমধ্যেই দুটি কীর্তি গড়েন কোহলি। বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি ক্রিকেটার কুমার সাঙ্গাকারা ও বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের নন-ওপেনার হিসেবে সর্বাধিক ১২টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ড ভেঙে দেন তিনি। এদিন লঙ্কানদের বিপক্ষে ফিফটি তুলে নেওয়ায় কোহলির ফিফটি সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩'তে। নতুন এই কীর্তি গড়তে কোহলির প্রয়োজন হয়েছে ৩৩ ইনিংস।
এছাড়া চলতি বছরে হাজারও এদিন পূরণ করেছেন কোহলি। তাতে পেছনে ফেলে দেন শচীন টেন্ডুলকারকে। এ নিয়ে আটবার এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে হাজার রান করলেন কোহলি। অর্থাৎ এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সবচেয়ে বেশিবার হাজার রান করা খেলোয়াড় এখন তিনি। এর আগে ২০১৯ সালের ক্যালেন্ডার ইয়ারে হাজার রান করে শচীনের সাতবারের রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন তিনি।
কোহলির বিদায়ের পর লোকেশ রাহুলের সঙ্গে ৬০ রানের জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন শ্রেয়াস আইয়ার। ব্যক্তিগত ২১ রানে চামিরার দ্বিতীয় স্বীকার হন রাহুল। এরপর শ্রেয়াসকে খুব বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে পারেননি সূর্যকুমার যাদব। তবে রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে ৫৭ রানের আরও একটি দারুণ জুটি গড়ে মাদুশাঙ্কার পঞ্চম শিকার হন শ্রেয়াস। ৫৬ বলের বিধ্বংসী ইনিংসে ৩টি চার ও ৬টি ছক্কায় ৮৮ রান করেন এই ব্যাটার। শেষ দিকে ২৪ বলে ৩৫ রানের ইনিংস খেলেন জাদেজা। শ্রীলঙ্কার হয়ে এদিন ১০ ওভার বল করে ৮০ রানের খরচায় ৫টি উইকেট নিয়েছেন মাদুশাঙ্কা।
Comments