পাগল: ‘তার ভোট চাইবে না গণতান্ত্রিক কোনো পক্ষ’

পাগল। ঢাকার ফার্মগেট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: রবাব রসাঁ

কলকাতার ভবানীপুরের বাসা থেকে যদুবাবুর বাজারে যাওয়ার রাস্তায় এক পাগলকে রীতিমতো 'বিধাতার সঙ্গে' সাপলুডো খেলতে দেখেছিলেন কবীর সুমন।

'বাবু হয়ে' ফুটপাতে বসে থাকা ওই পাগলকে নিয়ে সুমন গেয়েছিলেন, 'চালচুলো নেই তার/নেই তার চেনা বা অচেনা/আদমশুমারি হলে তার মাথা কেউ গুনবে না/তার ভোট চাইবে না গণতান্ত্রিক কোনো পক্ষ…'।

সুমনের গানের ওই পাগলের মতোই ছবির এই পাগলকে সম্প্রতি বিএনপির ডাকা অবরোধের এক সকালে ঢাকার ফার্মগেটের ফুটপাতে বসে থাকতে দেখা যায়। দেখার আগে-পরে সেও সাপলুডো খেলছিল কিনা, তা বোঝার সুযোগ হয় না। তবে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে নিবিষ্ট মনে দৈনিক পত্রিকা পড়তে দেখা যায় তাকে।

বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠে সংঘাত আর সহিংসতার মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগননা চলছে এখন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এখনো ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল বিএনপি। ভেঙে দেওয়া জোটের সাবেক শরিক ও আরও কয়েকটি সমমনা দলও আছে তাদের পথেই।

এর মধ্যে নতুন কয়েকটি দলের ভূমিকায় রাজনীতিতে নানামুখি আলোচনার ভেতরেই সারা দেশে ৩০০ আসনেই দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন রেখে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনও (ইসি)।

ইসির চূড়ান্ত হিসাব অনুসারে এবারের নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে নতুন ভোটার এক কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৬ জন।

কিন্তু এসব নিয়ে ফার্মগেটের ওই পাগলের কোনো মাথাব্যাথা থাকার কথা না। সংবাদপত্রের পাতায় আসা এ সংক্রান্ত কোনো খবর আদৌ তার মনে আলোড়ন তোলে কিনা তা জানাও কঠিন। তবে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ভোটার তালিকায় ফার্মগেটের ওই পাগলের নাম নেই। কেন এই ঊনমানুষদের নাম ভোটার তালিকায় থাকে না তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় সুমনের গানে। সুমন বলেন, 'সরকারে দরকার নেই তাই/নিজের সুড়ঙ্গে/পাগল/সাপলুডো খেলছে/বিধাতার সঙ্গে।'

বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিককার এক জরিপে দেশে এ ধরনের পাগলের সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১২ লাখ। এটা নিয়ে চমৎকার একটি ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার এক সংবাদপত্রে। ছড়াটি ছিল এ রকম—'দেশে নাকি পাগল বার লাখ, গণনাতে মিলবে আরও ত্রুটি/আমরা কি আর সবাই পাগল নই, গুনলে হবে হয়তো বারো কোটি'।

সে সময়ে দেশে ১২ কোটি জনসংখ্যার কথা বোঝাতেই সম্ভবত এটা বলা হয়েছিল।

সাধারণত যাদের কথাবার্তা বা নীরবতা সভ্যসমাজের দৃষ্টিতে অসমীচীন, নিরর্থক, অযৌক্তিক কিংবা হাস্যকর, অথবা যাদের বাহ্যিক আচরণ স্বভাবসিদ্ধ নয় তাদেরকেই পাগল বলা হয়। কারো দৃষ্টিতে এরা মানসিক রোগী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবাঞ্ছিত। এসব পাগলদের কথোপকথন বা নীরবতার ভাষা বুঝতে সভ্য মানুষ রাজি নয়। তাই কখনো এদের জায়গা হয় পাগলাগারদে; কদাচিৎ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে। আর সুমনের ভাষায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে 'হঠাৎ হাসপাতালে অকারণে ফাঁকতালে মহাপ্রয়াণ' ঘটে তাদের।

মিশেল ফুকোর ‘ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত

ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তার বিখ্যাত 'ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন' গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন পাগলামির প্রতি ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তনের ধাপগুলো। জানিয়েছিলেন, প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ মধ্যযুগে মানসিক ব্যাধি বা পাগলামি বিষয়টিকে পবিত্র হিসেবেই দেখা হতো। তবে রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে পাগলদের জন্য নতুন নিয়ম তৈরি করা হয়। এ পর্যায়ে এসব পাগল বা মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের জাহাজের মাধ্যমে দূরের কোথাও পাঠানো হতো। পরবর্তীতে এদের সমাজের ভেতরেই রাখা হয়।

ফুকো বলছেন, তখন পর্যন্ত পাগলামিকে একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে দেখা হতো না। তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে মানসিক চিকিৎসার পরিবর্তে সামাজিকভাবে শৃঙ্খলিত করা হতো। অনেকে পাগলামিকে আবার মানসিক সমস্যার পরিবর্তে শারীরিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতেন। আর তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, যা কখনো কখনো রোগীকে শারীরিক নির্যাতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেত।

ফুকো তার বইয়ে স্মরণ করিয়ে দেন, পাগলদের ওপর যখন এমন নির্যাতন চলছে তখন ইউরোপে পুরোদমে চলছে এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়নের যুগ। পরে পাগলামিকে যখন মানসিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখনো তাদের মুক্তি হয় না। তাদের জন্য শৃঙ্খলিত হওয়া কিংবা মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ থাকে না। এ পর্যায়েই পাগলদের ওপর মনোচিকিৎসকদের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

ফুকো ভাষ্য, 'জেলখানা এবং পাগলগারদ যে সামাজিক কাজগুলো করে স্কুলও সেসবই করে: সংজ্ঞায়িত করা, শ্রেণিবিন্যস্ত করা, শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করা।'

আবার বাংলাদেশের বাউলগানে পাগল বলতে ঠিক মানসিক রোগীকে বোঝানো হয় না। বরং খ্যাপা বাউল, বিশেষ দশাপ্রাপ্ত সাধকদের বলা হয়ে থাকে পাগল। পাগল সম্মেলনেরও খবর পাওয়া যায় এই দেশে, যার আয়োজক পাগলরাই।

লালন সাঁই ভাবের ঘোরে গান বেঁধেছিলেন: 'তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে'। কারা সেই পাগল, তার জবাবও গানে দিয়েছিলেন লালন। বলেছিলেন, 'ও সে চৈতে নিতে অদ্বে পাগল নাম ধরেছে'।

এখানে 'চৈতে' মানে শ্রীচৈতন্য, আর 'নিতে' ও 'অদ্বে' সেই চৈতন্যের দুই প্রধান পার্ষদ নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য। এই তিন পাগলের জাতপাতহীন এক অভিনব প্রেমধর্মের জোয়ারে ভেসেছিল নদীয়া।

এবার লালন থেকে সুমনে ফেরা যাক। সুমনের 'পাগল' গানটি ঠাঁই পেয়েছিল ১৯৯২ সালে প্রকাশিত 'তোমাকে চাই' অ্যালবামে। পরে ৯৪ সালে নিজের কয়েকটি গান রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে 'সুমনের গান সুমনের ভাষ্য' নামে বই প্রকাশিত হয়। সেখানে সুমন 'পাগল' গানটি রচনার পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, 'একদিন দেখি সে বাবু হয়ে ব'সে আছে।… সারাদেহে একটা টানটান চাপা উত্তেজনা। মুখটা সে একবার তুলছে ওপরের দিকে, তার পরেই ফের নামিয়ে আনছে নীচে। উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের মাটিতে।—একটু পরেই মুখটাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে সে আকাশের দিকে। কয়েক মুহূর্ত যেতে-না-যেতেই দৃষ্টি ফিরে আসছে নীচে। চোখদুটো চক্‌চক্‌ করে উঠছে কৌতূহলে, কৌতুকে।'

এই দৃশ্য দেখে সুমনের মনে হয়েছিল, পাগলটি অদৃশ্য কোনো প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলছে। তিনি বলতে থাকেন, 'নিজের দানের পর প্রতিপক্ষের দানের জন্য তার সকৌতুক অপেক্ষা। খেলায় আত্মহারা শিশুর মতো সে তখন উত্তেজনায় টানটান…।

'বাজার করছি আর ভাবছি, এই খেলোয়াড়ের প্রতিপক্ষ কে? কে আর এ জগতে খেলতে পারে তার সঙ্গে? আমি কি নিজে কখনও ভুলেও খেলতে বসব? অথবা আমার চেনাজানা অন্য কেউ?'

এখনকার নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলগুলোর কদর বেড়েছে সরকারি দলের কাছে। এ সময় রাজনীতিকদের কাছে কদর বাড়ে সাধারণ ভোটারদেরও। কিন্তু পাগলরা তো সেই সাধারণেরও নিচের তলায় অবস্থান করা গোষ্ঠী। আরও নিঃসঙ্গ, আরও বিচ্ছিন্ন। দুনিয়াবি কোনো অনুষঙ্গেই পাওয়া যায় না তাদের।

তাই হয়তো এক বিধাতা ছাড়া অন্য কোনো খেলার সঙ্গী মেলে না পাগলদের। প্রতিপক্ষও মেলে না। আর গণতান্ত্রিক কোনো পক্ষও ভোট চায় না তাদের কাছে।

Comments

The Daily Star  | English
Prof Yunus in Time magazine's 100 list 2025

Prof Yunus named among Time’s 100 Most Influential People of 2025

A tribute article on Prof Yunus was written by Hillary Clinton for the magazine

2h ago