বিজয়ের আনন্দে সেদিন কেঁদেছিলাম: চিত্রনায়ক সোহেল রানা

চিত্রনায়ক সোহেল রানা
চিত্রনায়ক সোহেল রানা। ছবি: সংগৃহীত

সোনালি দিনের সিনেমার নায়ক সোহেল রানা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেসময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা 'ওরা ১১ জন' এর প্রযোজকও তিনি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছেন একটা সময়ে। আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের স্মৃতি স্মরণ করে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা।

সোহেল রানা বলেন, 'ছাত্র রাজনীতি করতাম সেসময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে থাকতাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল তখন থেকেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করতাম। তারপর যুদ্ধ শুরু হলো। আমি যোগ দিলাম যুদ্ধে।

নদীর ওপার কেরানিগঞ্জে চলে যাই যুদ্ধের সময়ে। ট্রেনিং নিই। আঁটি বলে একটা জায়গা আছে। ওদিকেই ছিল ঘাঁটি। এত বছর পর সব স্মৃতি মনেও নেই। কিন্তু ডিসেম্বরের কথা মনে আছে। বিজয় অর্জনের কথা মনে আছে। আজও সেসব দিনের কথা মনে করে অন্যরকম শান্তি অনুভব করি।

যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে শত্রুর সাথে লড়াই করাই ছিল মূল লক্ষ্য। একটি পতাকা পাবো, স্বাধীন দেশ হবে—এই ভাবনা কাজ করত সবসময়। সম্মুখ যুদ্ধে সহযোদ্ধাদের হারাতে হয়েছে। কেউ আবার আহত হয়েছেন। এভাবেই যুদ্ধ করেছি। প্রতি মূহুর্তে মৃত্যু ভয় তাড়া করত। যেকোনো সময় মারা যাবার ভয় তাড়া করত। পাকিস্তানি মিলিটারি যে কোনো সময় ঘেরাও করে ফেলে—এসবও মনে হতো। রাজাকাররা চিনিয়ে দেয় কি না—তাও মনে হতো। কাজেই মৃত্যু ভয় যে ছিল না তা অস্বীকার করা যাবে না। এতসবের মধ্যেও সাহসী হয়ে উঠি। প্রচণ্ড সাহস নিয়ে যুদ্ধ করি।

মনে পড়ে, দেশ স্বাধীনের পর, এক-দেড় বছর ঘুম হয়নি। স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে। ঘুম হলেও মাঝরাতে কিংবা কিছু সময় পর ভেঙে যেত। যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা মনে পড়ত। চোখে ভাসত সবকিছু। কত অচেনা মানুষ সেসময় আমাদের উপকার করেছেন, থাকতে দিয়েছেন, রান্না করে খাইয়েছেন। সেজন্য আমি জোর দিয়ে বলি, সাত কোটি বাঙালি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। অল্প কিছু রাজাকার ছিল, তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দেশের সাথে।

১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে আমরা বুঝতে পারি স্বাধীন দেশ হতে যাচ্ছে, আমরা জয়ী হতে যাচ্ছি। আর ডিসেম্বরের শুরুতে আরও বেশি করে বুঝে যাই বিজয় ঘনিয়ে আসছে। আমরা আরও সাহসী হয়ে উঠি। আমরা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি।

তারপর কাঙ্ক্ষিত বিজয় এলো। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে আমরা বিজয় অর্জন করি। এই আনন্দের কথা বলে প্রকাশ করা যাবে না। বিজয়ের আনন্দ ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ। বিজয়ের মুহুর্ত ছিল জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহুর্ত।

আমরা উল্লাস শুরু করি। একেকজন একেভাবে বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করি। আমার হাতে স্টেনগান ছিল। স্টেনগান দিয়ে গুলি করে আনন্দ প্রকাশ করি। তাছাড়া সহযোদ্ধাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম সেদিন। বিজয় অর্জন করেছি এই আনন্দেই কেঁদেছিলাম। কিছুটা সময় আকাশে তাকিয়েছিলাম চুপচাপ। কথা বলতে পারছিলাম না।

১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হবার পর প্রায় সারারাত নির্ঘুম কেটেছিল। এরপর ১৭ ডিসেম্বর আমরা ঢাকা রওনা দিই। ৫০-৬০ জনের টিম ছিলাম। হেঁটে রওনা দিই। আমাদের দলে মোস্তফা মহসীন মন্টুও ছিল। ফেরার সময় আমাদের সবার মুখে ছিল বিজয়ের আনন্দ, দেশ পাবার আনন্দ, পতাকা পাবার আনন্দ। বীরের বেশে আমরা সেদিন ঢাকায় ফিরেছিলাম। বিজয়ের মতো বড় প্রাপ্তি এই জীবনে কী বা হতে পারে? সেটাই পেয়েছিলাম সেদিন।

তারপর ঢাকায় ঢুকে প্রথমে যাই ইকবাল হলে। ইকবাল হলেই আমি থাকতাম। সেখানে যাবার পর অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেকটা সময়। কেননা, সবার কথা তখন মনে পড়ছিল এবং ভাবছিলাম—অনেকেই হয়ত বেঁচে নেই।

একজন বাঙালি হিসেবে বড় গর্ব ১৯৭১ সালের বিজয় অর্জন', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

3h ago