শিক্ষার্থীকে ‘শূন্য’ দিয়ে শিক্ষকরা কী পেলেন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একজন শিক্ষার্থী মৌখিক পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছেন—বিষয়টি শুরুতে আমার বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছিলাম ওই শিক্ষার্থী হয়তো পরীক্ষায় উপস্থিত ছিলেন না। কারণ আট বছরের শিক্ষক-জীবনে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে আমার বিভাগ ও অন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে।

মৌখিক পরীক্ষায় সাধারণত ৫০ জন শিক্ষার্থী হলে তাদের মধ্যে ৪-৫ জন থাকেন যারা হয়তো ভাইভা বোর্ডে কোনো কারণে নার্ভাস থাকেন, কোনো কারণে তাদের প্রস্তুতি ভালো থাকে না। অথবা হয়তো মানসিক অবস্থা, মানবীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন, পারিবারিক সংকটসহ নানা কারণে বোর্ডে অনেক সময় তারা তেমন কিছু একটা উত্তর দিতে পারেন না।

এমন অবস্থায় দেখেছি বোর্ডের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা তাদের পাশে দাঁড়ান। সহযোগিতা করেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেন, আপনি যে বিষয় ভালো জানেন, সে বিষয়ে কিছু বলুন, আলোচনা করুন। যাতে ওই শিক্ষার্থীকে একটু সাহস দেওয়া যায়। যাতে তাকে একটু এগিয়ে দেওয়া যায়। অন্তত পাস নম্বরটুকু দিয়ে হলেও।

কিন্তু হায়! জবির ওই শিক্ষার্থী ভাইভা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, তাতে তিনি শূন্যও পেয়েছেন! সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের চূড়ান্ত বর্ষের ওই শিক্ষার্থীই হয়তো একমাত্র শিক্ষার্থী যিনি ভাইভাতে ফেল করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ওই শিক্ষার্থী! হয়তো এটা একটা অনন্য রেকর্ডও, যাতে ভূমিকা রেখেছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা!

বৃহস্পতিবার দিনভর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনার বিষয় ছিল মৌখিকে ওই শিক্ষার্থী শূন্য পাওয়া। কতটা আক্রোশ, কতটা প্রতিহিংসা থাকলে সন্তান-সমতুল্য এক শিক্ষার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় শূন্য দেওয়া যায়—সেটাই ভেবেছেন সংবেদনশীল শিক্ষকরা।

তবে হ্যাঁ, শিক্ষার্থী ভাইভাতে শূন্য পেতেও পারেন, অকৃতকার্য হতেই পারেন, যদি না তার বিষয়টি খুবই টেকনিক্যাল হয়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ফিল্ম অ্যান্ড টিভি বিভাগ কি সেই অর্থে টেকনিক্যাল কোনো বিভাগ, যার মৌখিক পরীক্ষায় যথাযথ মূল্যায়ন শেষে অকৃতকার্য হয়েছেন ওই শিক্ষার্থী?

বরং এটাই বিশ্বাসযোগ্য যে, ওই শিক্ষার্থী তার অ্যাকাডেমিক যাত্রায় শিক্ষকদের সহযোগিতার বদলে প্রবল আক্রোশের শিকার হয়েছেন। মানসিক সহযোগিতার বদলে পেয়েছেন তিরস্কার। কোনো না কোনোভাবে তাকে প্রবল চাপে ফেলা হয়েছে। তার শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করা হয়েছে। মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। শ্রদ্ধেয় যে শিক্ষকরা এই ঘৃণ্য কাজটি করেছেন, তাদের সন্তানের সঙ্গে কেউ যদি এমন আচরণ করেন, সেটা তারা মেনে নিতে পারবেন তো!

অনার্স প্রথম বর্ষে একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন, তখন তিনি খুবই নাজুক অবস্থায় থাকেন। চারদিকে অচেনা পরিবেশ, নানা বিপদের হাতছানির মধ্যে একজন শিক্ষক হতে পারেন এক শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেন্টর, সহায়ক, পথপ্রদর্শক। কিন্তু হায়, ওই শিক্ষার্থী যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তা তো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। একজন স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা প্রত্যাশা করেন, শিক্ষকরা তার সন্তানের পিতৃতুল্য হবেন। অগ্রগতির পথে বাধা বা নিপীড়ক নন।

এখন পর্যন্ত ওই শিক্ষার্থীর অভিযোগ ও অবন্তিকার আত্মহত্যা বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন অত্যন্ত সংবেদনশীল, ত্বরিত ও ইতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এটা যাতে শেষ না হয়। সময়ের সঙ্গে আমরা যাতে এই ভুলগুলো ভুলে না যাই। কোথাও যাতে শিথিলতা না আসে।

হাজার বছরের চীনা সভ্যতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে—'অ্যা ডে অ্যাজ অ্যা টিচার, অ্যা লাইফটাইম অ্যাজ অ্যা ফাদার'। যার মর্ম কথা—একজন শিক্ষক মাত্র একদিন ক্লাস নিয়ে বা শিক্ষাদান করে সারাজীবনের জন্য একজন শিক্ষার্থীর পিতৃত্বের আসন পেতে পারেন। তিনি এমন জ্ঞান বা আলোর সন্ধান দিতে পারেন, যাতে একজন শিক্ষার্থী সারাজীবন ঠিক পথে চলতে পারেন। কিন্তু হায়! ওই শিক্ষার্থীকে যে উপাখ্যানে আমরা দেখলাম, একজন শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে, প্রবল আক্রোশের সঙ্গে একজন সন্তানের জীবনকে অন্ধকার করে দিচ্ছেন। হয়তো পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

যারা একজন শিক্ষার্থীকে সন্তান-সমতুল্য মনে করতে পারবেন না, যারা শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা খুঁজতে চান—আপনারা শিক্ষকতায় আসবেন না। নিবেদিতপ্রাণ-সংবেদনশীল শিক্ষকদের পেশাকে আর বিতর্কিত-কালিমালিপ্ত করবেন না, দয়া করে।

লেখাটি শেষ করতে চাই একটি জাপানি প্রবাদ দিয়ে। সমৃদ্ধ জাপানি সভ্যতায় শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে বলা হয়েছে—'বেটার দ্যান অ্যা থাউজ্যান্ড ডেস অব ডিলিজেন্ট স্টাডি ইজ ওয়ান ডে উইথ অ্যা গ্রেট টিচার'। যার অর্থ—হাজার দিনের পরিশ্রমী পড়াশোনার চাইতে একজন মহান শিক্ষকের সান্নিধ্যে কাটানো একটি দিন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নিবেদিতপ্রাণ, মহান শিক্ষকের অভাব নেই, যারা মেধা-শ্রম-প্রজ্ঞা দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনকে আলোকিত করে যাচ্ছেন। আশা করি, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এই শিক্ষকদের প্রতি আস্থা রাখবেন।

সবশেষে বলতে চাই, ওই শিক্ষার্থীকে শূন্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা কী পেয়েছেন আমি তা জানি না। তবে নিশ্চিতভাবেই হারিয়েছেন আস্থা আর বিশ্বাস, যা ফেরাতে হয়তো শিক্ষক-সমাজের অনেক সময় লাগবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

8h ago