‘মার্ডার, টেকনিক্যালি মার্ডার’

মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাসের কয়েকটি লাইন বারবার যেন কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—‘আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন... বিশ্বাস করেন...’।

১৫ মার্চ মধ্যরাতে যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন মেয়েটি কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে। হিমঘরে মেয়েটির শরীর হয়তো এখন বরফ শীতল। হয়তো তার শেষশয্যার জায়গা নির্বাচন ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে সে যখন সব সমীকরণের বাইরে, তখন ফেসবুকের ফিডে মেয়েটিকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা, আপলোড হচ্ছে ছবি, চলছে প্রতিবাদ, ধিক্কার জানানো হচ্ছে অভিযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রতি।

এই যখন সার্বিক পরিস্থিতি, তখন ফাইরোজ অবন্তিকার প্রতিষ্ঠানের একজন সামান্য শিক্ষক হিসেবে আমার ঘুম আসছে না। চোখের পাতা এক করতে পারছি না। মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাসের কয়েকটি লাইন বারবার যেন কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—'আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন... বিশ্বাস করেন...'।

আমি মনে করি, একজন মানুষ খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এমন সিদ্ধান্তের দিকে যায় এবং এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চিতভাবে খুবই কঠিন। আর খুব সম্ভবত এর পেছনে একক নয়, বরং বিবিধ কারণ একসঙ্গে কাজ করে।

তবে হ্যাঁ, একটা আঘাত বা অপমান হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিতে শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। সামান্য শিক্ষাবিদ হিসেবে এটা আমার ধারণা। মনোবিদ ও চিকিৎসকরা নিশ্চয় এ বিষয়ে গবেষণালব্ধ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরোজ অবন্তিকার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছে তা এখনই পরিষ্কার করে বলা কঠিন। এর জন্য নিবিড় ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত প্রয়োজন। যাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাত্ত হবে মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাস।

ফাইরোজ অবন্তিকার আত্মহত্যায় দুটি বিষয় সামনে এসেছে।

১. অনলাইনে নিপীড়ন

২. এক শিক্ষকের (সহকারী প্রক্টর) অসংবেদশীল আচরণ।

কয়েক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুবই সংবেদনশীল এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিছুটা অধিকতর ঝুঁকির একটা বয়সে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে তারা প্রবেশ করেন। এ সময় তারা প্রাকৃতিকভাবে নানা ধরনের মানবীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। অনেকেই হয়তো বুঝে বা না বুঝে নানা ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত নেন। যা তাদের মানসিক অবস্থা ও শিক্ষাজীবনকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করে।

আমার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী এমন কয়েকটি বিষয়ে আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি আমার তরফে সামান্য চেষ্টার পর তাদের বিভাগের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা কেন্দ্রের সাহায্য নিতে বলেছিলাম। হয়তো তারা এতে কিছুটা উপকৃত হয়েছিলেন।

তবে অনলাইনে নিপীড়ন যে ভয়াবহ একটা বিষয়, তা দিনদিন আমাদের সামনে নতুনভাবে হাজির হচ্ছে। ফাইরোজ অবন্তিকা অনলাইন ও অফলাইনে তার সহপাঠীর দ্বারা নিপীড়িত হওয়ার অভিযোগ করে গেছেন বিদায়ী বার্তায়। বিষয়টা আগেভাগে যথাযথভাবে আমলে নিতে পারলে হয়তো মেয়েটাকে বাঁচানো যেতো।

এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি। একটু আগেই বলেছি, বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আসেন, তখন তারা খুবই সংবেদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ একটা অবস্থায় থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রথমবারের মতো পরিবার ছাড়া থাকেন। তাদের নানা বিষয়ে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একা চলতে হয়। এ সময় শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হতে পারে তাদের আস্থার একটি জায়গা, ভরসার জায়গা, একটি আশ্রয়স্থল।

কিন্তু এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক বা দায়িত্বশীল পদে থাকা কোনো শিক্ষক যদি অসংবেদনশীল ও নিপীড়নমূলক আচরণ করেন, তাহলে যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্যই তা সহ্য করা কঠিন। হয়তো ফাইরোজ অবন্তিকার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। যথাযথ তদন্তের পরই হয়তো তা জানা যাবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সামাজিক বিজ্ঞান ভবনে অষ্টম তলায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। সপ্তম তলায় ফাইরোজ অবন্তিকার আইন বিভাগ। বিভাগে পৌঁছাতে অনেক সময় আমরা একই লিফট ব্যবহার করি। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের লিফট ব্যবহার করেন, আমরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লিফটে উঠি। নিত্যদিনের এই চলাচলে ফাইরোজ অবন্তিকা নামে এই মেয়েটিকে সহজেই নজরে পড়তো। অগ্রসর, চটপটে, চঞ্চল এই প্রাণটির এভাবে নিভে যাওয়া সত্যিই বেদনা জাগাচ্ছে। আক্ষেপ বাড়াচ্ছে...।

মনের অজান্তেই বারবার স্ক্রল করছি, মেয়েটির বিদায়ী বার্তা। কী করুণ, কী কঠোর উচ্চারণ—'আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন...'।  পরের দিকে মেয়েটি লিখেছেন, 'এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।'

এই 'মার্ডার'র যথাযথ তদন্ত ও শাস্তি হলে হয়তো আগামীর মার্ডারগুলো ঠেকানো যাবে। আমরা কি আগামী দিনের মার্ডারগুলো ঠেকাবো, নাকি যতো দ্রুত সম্ভব এই ঘটনাটাই ভুলে যাবো?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments